কূটনীতিতে নতুন রূপ
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বেইজিং ছিল বিশ্বনেতাদের আনাগোনায় ভরপুর। ২০ জনেরও বেশি নেতা চীন সফর করেছেন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে। পরের মাসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন সফর করলে আরও বড় আয়োজনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে চীনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—কী বলা হবে এবং কোন ভঙ্গিতে বলা হবে। আমাদের তৈরি করা নতুন সূচক জানাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বহুল ব্যবহৃত এক ধরনের কূটনৈতিক ভঙ্গি এখন আর দেখা যাবে না—যেটি পরিচিত ছিল “উলফ ওয়ারিয়ার” নামে।
‘উলফ ওয়ারিয়ার’ কূটনীতি কী?
এই কূটনৈতিক ধারা নাম নিয়েছে জনপ্রিয় দেশপ্রেমমূলক চলচ্চিত্র সিরিজ উলফ ওয়ারিয়ার থেকে, যেখানে চীনা র্যাম্বোর মতো চরিত্র লেং ফেং বিদেশি শত্রুদের মোকাবিলা করেন। এর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন ঝাও লিজিয়ান, যিনি ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ছিলেন। একবার তিনি ব্লুমবার্গের সাংবাদিককে বলেছিলেন, ফাইভ আইস জোটের সদস্যরা সাবধান না হলে “তাদের চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।”

কেন এই আক্রমণাত্মক কূটনীতি শুরু হয়েছিল?
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতো আসাই মনে করেন, হয়তো শি জিনপিং চেয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাঝে আদর্শিক শৃঙ্খলা জোরদার করতে। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি ছিল কোভিড-১৯–এর মতো অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর কৌশল। ফ্রান্সে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত লু শায়ে বলেছিলেন, এটি ছিল “আত্মরক্ষামূলক” প্রতিক্রিয়া।
‘উলফ ওয়ারিয়ার’ সূচক
আমরা ২০১৮ সাল থেকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রদের দেওয়া প্রায় ১৬ হাজার সংবাদ সম্মেলনের উত্তর বিশ্লেষণ করেছি। এরপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে প্রতিটি উত্তরকে ০ থেকে ১ এর মধ্যে আক্রমণাত্মকতার স্কোর দেওয়া হয়। দেখা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে কূটনীতিতে আক্রমণাত্মকতা হঠাৎ বেড়ে যায়। গড় স্কোর ২০১৮ সালে ০.৩-এর নিচে থাকলেও ২০২১ সালের মে মাসে তা বেড়ে ০.৪৫ ছাড়ায়। তবে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে ভাষার ভঙ্গি ক্রমশ নরম হয় এবং ২০২৫ সালের শুরুতে তা ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছায়।

কাদের প্রতি আক্রমণাত্মকতা বেশি?
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়েছে আমেরিকাকে কেন্দ্র করে। যেখানে আক্রমণাত্মকতার স্কোর ০.৭-এর ওপরে ছিল, সেখানে প্রায় অর্ধেক উত্তরে “আমেরিকা” বা “আমেরিকান পক্ষ” শব্দ এসেছে। অন্যান্য ঘন ঘন ব্যবহৃত শব্দ হলো “নিরাপত্তা” (৩২%), “নীতিমালা” (২৫%), এবং “সার্বভৌমত্ব” (২৩%)। আর তাইওয়ান প্রসঙ্গ এসেছে ১৬% উত্তরে।
ক্ষতি কী হলো?
কয়েক বছরের মধ্যেই এই উলফ ওয়ারিয়ার কূটনীতি চীনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। তাদের বক্তব্য অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে। বিশ্বব্যাপী জনমতও চীনের বিরুদ্ধে যায়। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েইফাং শুর গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের বক্তব্য চীনা নাগরিকদের সরকার সমর্থনে উৎসাহিত করলেও আমেরিকানদের বিরক্ত করে তোলে এবং তারা চীনের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি সমর্থন করে।

নরম হওয়ার কারণ
এসব অভিজ্ঞতাই চীনকে নতুন কৌশল নিতে বাধ্য করেছে। ২০২১ সালে শি জিনপিং নিজে বৈঠক ডেকে আলোচনা করেছিলেন কীভাবে চীনের “বিশ্বাসযোগ্য, প্রিয় এবং সম্মানিত” ভাবমূর্তি গড়ে তোলা যায়। হংকং-এর চাইনিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক দুয়ান জিয়াওলিন মনে করেন, অর্থনৈতিক উদ্বেগও এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে। অনিশ্চিত সময়ে বাণিজ্যিক অংশীদারদের ভয় দেখানো কূটনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারত। তাই চীন ধীরে ধীরে লু শায়ের মতো উলফ ওয়ারিয়ারদের থেকে দূরে সরে এসে নরম ভঙ্গি বেছে নিচ্ছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















