হরিদোহা নদী নরসিংদী জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা শুধু ভৌগোলিক দিক থেকে নয়, স্থানীয় জনজীবন, সংস্কৃতি ও পরিবেশের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। নদীটির অনেকগুলো দিক এখনও গবেষণার অপেক্ষায়, তবে পাওয়া গেছে কিছু তথ্য, যে ভিত্তিতে আমরা নদীর ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যত নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারি।
ভৌগোলিক অবস্থা ও মৌলিক তথ্য
হরিদোহা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ প্রায় ৬১ মিটার। নদীটি সর্পিলাকার প্রবাহযুক্ত এবং বাঁকে বাঁকে ঘুরে চলেছে। এটি নরসিংদী জেলার নরসিংদী সদর, শিবপুর ও পলাশ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীর উৎস ‘বিলাঞ্চল মোহনা মেঘনা নদী’ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
নদী হরিদোহা পুরাতন ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত লেখা তথ্য কম পাওয়া যায়। তবে স্থানীয় জনমত ও কিছু নথি থেকে জানা যায় যে, একসময় নদীটি ছিল নৌপথ ও যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। লোকজন নৌকা বা ছোট লঞ্চ ব্যবহার করে কৃষি ও বাণিজ্যের পণ্য পরিবহন করতেন। নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে নদী ছিল উৎসব, মিলনসভা এবং জনসমাবেশের স্থান। মাছ ধরা, নৌ-বাহার এবং বিনোদনের জায়গা হিসেবেও এটি পরিচিত ছিল। নদীর নাম হরিদোহা স্থানীয়ভাবে প্রচলিত হয়, যা ভৌগোলিক অভিধানের পরিবর্তন ও ভাষাগত রূপান্তরের ফল হতে পারে।

বর্তমান অবস্থা ও প্রভাব
বর্তমানে হরিদোহা নদী নানা সমস্যায় জর্জরিত। নদীতে কারখানা ও আবাসিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, আর নদীর পাড়ে গজিয়ে উঠছে কচুরিপানা। এতে তলদেশ ঢেকে যাচ্ছে এবং পানির গতি কমে আসছে। ফলে পানির স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে, মাছের প্রজাতি কমছে এবং জলজ জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে।
অর্থনৈতিকভাবে নদীর ব্যবহারও কমে গেছে। নৌপরিবহন এখন আর আগের মতো সক্রিয় নয়, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে সেচ ব্যবহারে এর ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি নদীর সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় পর্যটনের আকর্ষণও কমে গেছে।
তবে ইতিবাচক দিক হলো, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, কচুরিপানা অপসারণ এবং নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে নদীর পুনর্জীবন সম্ভব হতে পারে।
প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
হরিদোহা নদী রক্ষায় কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, দূষণ নিয়ন্ত্রণের অভাব। কারখানা ও গৃহস্থালি বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে নদীতে ফেলা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। তৃতীয়ত, শুকনো মৌসুমে পানির ঘাটতির কারণে নৌ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া নদীর তীরবর্তী জমি ভরাট ও দখলের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং প্রশাসনিক উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপরন্তু, নদীর ইতিহাস ও উৎসসংক্রান্ত গবেষণা ও প্রমাণযোগ্য নথির ঘাটতিও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও রক্ষার উপায়
হরিদোহা নদীকে পুনরুজ্জীবিত করতে একটি পরিকল্পিত পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নেওয়া জরুরি। সরকার, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, নদীর প্রবাহ বজায় রাখা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার উন্নয়ন একসঙ্গে বিবেচনা করা সম্ভব হবে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি গণসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং কচুরিপানা অপসারণ পরিবেশবান্ধব উপায়ে চালু রাখতে হবে। শুকনো মৌসুমে পানির প্রবাহ বজায় রাখতে উৎসস্থল থেকে বাধা দূর করা এবং নৌপথের ঘাট ও সেতুগুলো সংস্কার জরুরি।
এছাড়া নদীর সাথে সম্পর্কিত স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী ঘাট, উৎসব ও লোকগাথা সংরক্ষণ এবং প্রচার করলে সামাজিক অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পাবে। গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে নদীর প্রাচীন ইতিহাস, উৎস, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনসমূহ নথিভুক্ত করা হলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মূল্যবান হবে।
হরিদোহা নদী নরসিংদীর একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাকৃতিক সম্পদ, যা বর্তমানে অবহেলিত ও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এটি শুধু কৃষি, পরিবহন কিংবা বসবাসের ক্ষেত্রেই নয়, মানুষের অনুভূতি, স্মৃতি ও সংস্কৃতির সাথেও গভীরভাবে জড়িত। সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া গেলে—দূষণ নিয়ন্ত্রণ, নাব্যতা পুনরুদ্ধার, সচেতনতামূলক উদ্যোগ ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন—এই নদী আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে এবং নদীতীরবর্তী সমাজকে আরও সংগঠিত ও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















