বাংলাদেশ ২০২৬ সালে সর্বনিম্ন উন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত করেছে এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য অংশীদাররা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সম্প্রতি ব্যবসায়ী মহল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করে জানিয়েছে, তাদের মতে এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা আরও তিন বছর পিছিয়ে দেওয়া জরুরি, কারণ ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় তারা এখনো প্রস্তুত নয়।
ব্যবসায়ী মহলের উদ্বেগ
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এলডিসি মর্যাদার কারণে নানা ধরনের বাণিজ্য সুবিধা পেয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা, উন্নত দেশের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, ও সহজ শর্তে আন্তর্জাতিক ঋণ প্রাপ্তি ব্যবসা ও অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব সুবিধার অনেকটাই ধীরে ধীরে উঠে যাবে।
ব্যবসায়ী মহলের আশঙ্কা হলো—
- • রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা কমে যাবে।
- • ঋণের শর্ত কঠোর হবে।
- • ভর্তুকি ও কর অবকাশের সুযোগ সীমিত হবে।
তারা মনে করছেন, করোনোত্তর অর্থনীতি, বৈশ্বিক মন্দা এবং ইউক্রেন যুদ্ধজনিত বাজার অস্থিরতার কারণে এখনই উত্তরণের ধাক্কা সামলানো কঠিন।
রাজনৈতিক দলের অবস্থান
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে এ বিষয়ে সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও মূল দায়িত্ব সরকারের। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলে আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, তবে সিদ্ধান্ত প্রয়োগের ক্ষমতা সরকারেরই। সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) লবিং ও উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ বাণিজ্য চুক্তিই এখানে কার্যকর হতে পারে।
সময় বাড়ানোর সম্ভাবনা কতটা?
এলডিসি থেকে উত্তরণ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। জাতিসংঘ একাধিক সূচক (যেমন মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক, এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক) যাচাই করে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এসব সূচকে উত্তীর্ণ হয়েছে। ফলে সময় বাড়ানো এখন প্রায় অসম্ভব।
তবে কিছু ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ থাকতে পারে:
- • উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাণিজ্য সুবিধা চালু রাখা।
- • ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে “ইবিএ প্লাস” বা সমমানের চুক্তি করা।
- • বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোতে স্থানীয় সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান।
সরকারের করণীয়
সরকার চাইলে এখন থেকেই ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন—
- • নীতিগত সহায়তা: রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে প্রণোদনা।
- • আর্থিক সহায়তা: ব্যাংকঋণ ও সুদের হার কমানো।
- • বাজার সম্প্রসারণ: এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে নতুন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি।
- • দক্ষতা উন্নয়ন: শ্রমশক্তিকে আধুনিক প্রযুক্তি ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষণ দেওয়া।
বাস্তবতা হলো—এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি মর্যাদার বিষয় এবং এটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্বীকৃতি। ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ যৌক্তিক হলেও সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। এখন মূল কাজ হলো কূটনৈতিকভাবে বাণিজ্য সুবিধা আদায়, অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানো। রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে আলোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত সরকার ও রাষ্ট্রের সমন্বিত কৌশলই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথ।