সরকারি অর্থব্যবস্থায় নতুন বাস্তবতা
বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপে রয়েছে—ঋণের বোঝা, অনিশ্চিত রাজস্ব, আর নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে, আরও স্মার্টভাবে ব্যয় করতে এবং জনআস্থা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখানে এক অনন্য সুযোগ তৈরি করছে, যা সরকারি সম্পদের পরিকল্পনা, বণ্টন ও হিসাবব্যবস্থাপনাকে আমূল পাল্টে দিতে পারে।
আধুনিক অর্থনীতিতে এআই-এর ব্যবহার
এআই শুধু স্বয়ংক্রিয়করণে সীমাবদ্ধ নয়; তাৎক্ষণিক তথ্য বিশ্লেষণ, ঝুঁকি পূর্বাভাস ও সম্পদ বণ্টনকে গতিশীল করছে। বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে কার্যকর উদাহরণ দেখা যাচ্ছে—
- ম্যাক্রোঅর্থনীতি ও রাজস্ব পূর্বাভাস: অস্ট্রেলিয়ার ট্যাক্স অফিস এআই ব্যবহার করে কর আদায়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিদিন জাতীয় কোষাগারের আপডেট প্রকাশ করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও রাজস্ব পূর্বাভাসে এআই কাজে লাগাচ্ছে।
- বাজেট পরিকল্পনা ও ব্যয় পর্যবেক্ষণ: ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া এআই দিয়ে নীতি মূল্যায়ন ও আর্থিক ঝুঁকি নিরূপণ করছে।
- সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা: যুক্তরাজ্য বাজেট প্রস্তাব বিশ্লেষণে HMT-GPT ব্যবহার করছে, আর কানাডা জনসম্পদ বণ্টনে এআই-এর সহায়তা নিচ্ছে।
- হিসাবরক্ষণ ও জালিয়াতি শনাক্তকরণ: ডেনমার্ক ভর্তুকি প্রদানের অনিয়ম শনাক্তে এআই ব্যবহার করছে। যুক্তরাজ্য প্রতারণামূলক দাবি দ্রুত ধরতে এআই কাজে লাগাচ্ছে।
- নাগরিক সেবা: যুক্তরাষ্ট্রে ট্যাক্স বিভাগ এআই-চালিত ভয়েস ও চ্যাটবট ব্যবহার করছে। আয়ারল্যান্ড কর-সংক্রান্ত নথি সংক্ষেপে এআই ব্যবহার করছে।
সীমাবদ্ধতা ও মৌলিক প্রশ্ন
এআই এখনো সরকারি অর্থনীতিতে মূলত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করছে, নিজে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। কারণগুলো হলো—
- এআই-এর পরামর্শ ব্যাখ্যা করা কঠিন।
- জবাবদিহিতার কাঠামো স্পষ্ট নয়।
- পক্ষপাত, নৈতিকতা ও ন্যায্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
কোনো এআই সিস্টেম কি নির্ধারণ করবে কোথায় অর্থ ব্যয় হবে বা কোন প্রকল্প বাতিল হবে? ভুল হলে দায় নেবে কে? এসব গভীর শাসন-সংক্রান্ত প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত।
এআই ব্যবহারে প্রধান প্রতিবন্ধকতা
সরকারি অর্থব্যবস্থায় এআই প্রসারে কয়েকটি মূল বাধা রয়েছে—
- কৌশলগত দিকনির্দেশনার অভাব: জাতীয় অগ্রাধিকার অনুযায়ী এআই ব্যবহারের রোডম্যাপ অনুপস্থিত।
- পুরনো প্রযুক্তি ও বিচ্ছিন্ন তথ্যভাণ্ডার: সমন্বিত ডেটার অভাবে মডেল প্রত্যাশিতভাবে কাজ করে না।
- ক্ষমতা ও সংস্কৃতির ঘাটতি: অনেক প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল দক্ষতা ও পরিবর্তনের সংস্কৃতি অপর্যাপ্ত।
- নৈতিকতা, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার সংকট: অনৈতিক ব্যবহারে নাগরিক আস্থা ক্ষুণ্ন হতে পারে।
- প্রভাব ও ফলাফল মূল্যায়নের ঘাটতি: বিনিয়োগের ফল নির্ভুলভাবে পরিমাপ না হলে স্থায়ী সমর্থন পাওয়া কঠিন।
কৌশলগত অগ্রগতি: করণীয়
এআই ব্যবহারে সফল হতে সরকারকে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে—
- জাতীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এআই ব্যবহার পরিকল্পনা করা।
- আধুনিক ক্লাউড অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং দক্ষ জনবল তৈরি করা।
- শক্তিশালী ডেটা-শাসননীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
- কেবল খরচ-সাশ্রয় নয়; নির্ভুলতা, ন্যায্যতা ও নাগরিক আস্থা—এই মানদণ্ডে এআই-এর প্রভাব মূল্যায়ন করা।
- স্বচ্ছতা, স্বাধীন নিরীক্ষা ও স্পষ্ট জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে এআই দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা।
সময় এখনই
এআই শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়; এটি সরকারি অর্থব্যবস্থাপনায় এক মৌলিক রূপান্তর। যথাযথ প্রয়োগ হলে এআই সরকারকে আরও দ্রুত, সঠিক ও স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখাও জরুরি। দায়িত্বশীলভাবে প্রয়োগ করা গেলে এআই সরকারের জন্য ঝুঁকি মোকাবিলা, নীতি ফলাফল উন্নয়ন এবং নাগরিক আস্থা পুনর্গঠনের এক কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।