শোকের ভারে শিশুদের জীবন
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বুনের জেলার নয় বছরের মুহাম্মদ আজান এখন তার চাচার কাছে থাকে। আগস্টের মাঝামাঝি ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় তার বাবা-মা ও তিন ভাই মারা যান। চাচা শামস উর রহমান বলেন, “আজান সবকিছু দেখেছে। জানে তার বাবা-মা আর নেই। কিন্তু এখনো বোঝে না কীভাবে তাদের ছাড়া বাঁচতে হয়।”
একই জেলায় ১৭ বছরের কাদির আহমেদের জীবনও পাল্টে গেছে। ১৫ আগস্ট বন্যায় তার বাড়ি ভেঙে পড়ে এবং স্রোতে মা ভেসে যায়। এখন তাকে চার ভাই-বোনের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কদিন আগেই সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল এবং কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু হঠাৎই পরিবারের প্রধানের দায়িত্ব এসে পড়েছে তার কাঁধে। কাদিরের কথায়, “আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি আর মা হারানোর পর ভাই-বোনদের দেখাশোনা করা খুব কঠিন।”
ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র
পাকিস্তানে জুনের শেষ থেকে নজিরবিহীন বন্যা ও ভূমিধসে এক হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে এবং প্রায় ১,১০০ জন আহত হয়েছে। কেবল খাইবার পাখতুনখোয়াতেই প্রায় অর্ধেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং প্রায় ৪,৭০০ বাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাঞ্জাবে আগস্টের মাঝামাঝি অভূতপূর্ব বৃষ্টিপাতের ফলে বড় নদীগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে। ভারতীয় সীমান্ত থেকেও পানি প্রবাহিত হয়ে অনেক গ্রাম ও কৃষিজমি ডুবে যায়। দুই মিলিয়নের বেশি মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়েছে, আর পানিবাহিত রোগের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গিলগিট-বালতিস্তানে ভূমিধসে সম্পূর্ণ উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, এবং তিন হাজারের বেশি মানুষ অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। সিন্ধু প্রদেশে অন্তত দেড় লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আজান ও কাদিরের অভিজ্ঞতা পাকিস্তানের লাখ লাখ শিশুর ট্র্যাজেডির এক ঝলক মাত্র।
চিকিৎসাহীন মানসিক আঘাত
গিলগিট-বালতিস্তানের খালতি গ্রামের শিক্ষক ওয়াসিম আক্রম জানান, আগস্টের মাঝামাঝি তার স্কুল বন্ধ হয়ে যায় বন্যা ও ভূমিধসের কারণে। তিনি বলেন, “শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে না। তাদের বই নেই, ইউনিফর্ম নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই। আচরণ পাল্টে গেছে — কখনো রাগ, কখনো ভয়, কখনো নীরবতা প্রকাশ করছে। অনেকেই হয়তো আর স্কুলে ফিরবে না।”
রেসকিউ ১১২২-এর গণমাধ্যম সমন্বয়ক মুহাম্মদ সোহেল বলেন, উদ্ধার তৎপরতা মূলত শারীরিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য সমান জরুরি। কিছু কর্মকর্তাকে প্রাথমিক মানসিক সহায়তায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এতে শিশুদের মনে বছরের পর বছর দাগ থেকে যায়।
সামাজিক কর্মী ফারিহা শেখ পাঞ্জাবের সিয়ালকোট ও নারোয়ালের দুর্গত গ্রামে ত্রাণ বিতরণে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “শিশুরা সবচেয়ে অসহায়। পরিবারগুলো ঘরহারা হয়ে খোলা আকাশের নিচে বা অস্থায়ী আশ্রয়ে আছে। শিশুদের চোখে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা স্পষ্ট।” অনেক শিশুই আতঙ্কজনিত সমস্যায় ভুগছে।
শিক্ষা ও জীবনের ব্যাঘাত
শেখ জানান, অনেক শিশু বাবা-মা হারিয়েছে। “তারা পুরোপুরি বোঝে না কী ঘটেছে, কিন্তু জানে বাবা-মা আর নেই। এর পাশাপাশি তারা নোংরা পানির কারণে অসুস্থ হচ্ছে, খাবারের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে, আর স্কুলগুলো হয় ধ্বংস হয়েছে, অথবা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।”
শুধু পাঞ্জাবেই সাত লাখের বেশি শিশু শিক্ষা বিঘ্নিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ২,৯০০ স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। ইউনিসেফ সতর্ক করেছে, স্কুল দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে শিশুরা ঝরে পড়বে এবং তাদের শিশু শ্রম বা বাল্যবিয়েতে ঠেলে দেওয়া হতে পারে।
নীতির ব্যর্থতা
পরিবেশবিদ ইয়াসির দরিয়া মনে করেন, পাকিস্তানের অপ্রস্তুতি এবং দুর্বল শাসন ব্যবস্থাই এই বিপর্যয়কে ভয়াবহ করেছে। ২০২২ সালের বন্যার পর যে আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ার কথা ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে জনগণ অরক্ষিত রয়ে গেছে। তার মতে, “এটি কেবল জলবায়ু সংকট নয়, সামাজিক সংকটও।”
বিশেষজ্ঞরা “পরিবেশ-নির্ভর প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতা (E-ACEs)” নামে একটি ধারণা উপস্থাপন করেছেন। তারা বলছেন, বন্যা, বাস্তুচ্যুতি ও পরিবার বিচ্ছিন্নতার পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে। পাকিস্তানের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে এ সমস্যা আরও প্রকট।
শিশুদের জন্য নীতিতে ঘাটতি
এ বছর প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২১০০ সালের মধ্যে জনসংখ্যায় শীর্ষে থাকবে এমন ১০ দেশের মধ্যে পাকিস্তানসহ শুধু ছয়টি দেশ তাদের জলবায়ু নীতিতে শিশু বা যুবকদের উল্লেখ করেছে। কিন্তু এগুলোও মূলত শিশু মৃত্যুহার নিয়ে সীমাবদ্ধ। পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনগুলো সেখানে অনুপস্থিত।
বাস্তবে, আজান ও কাদিরের মতো পরিবারগুলো কিছুদিনের খাবার ও তাঁবু পেলেও মাসের পর মাস শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে।
টিকে থাকার বাইরেও প্রয়োজন
শিক্ষক আক্রম বলেন, “শুধু ত্রাণ নয়, পুনর্গঠন জরুরি। শিশুদের স্থিতিশীল জীবন দরকার। আমাদের প্রয়োজন বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, লাইব্রেরি, খেলার জায়গা — যাতে তারা আবার স্বাভাবিক জীবন অনুভব করতে পারে। নইলে তারা ভবিষ্যৎ হারাবে।”
সামাজিক কর্মী শেখের কথায়, “শিশুদের খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধের পাশাপাশি নিরাপদ জায়গা ও যত্ন দরকার। তাদের মানসিক অবস্থা ঠিক রাখা শারীরিক বেঁচে থাকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ।”
পানি নামার পর অনেক পরিবার ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু শিশুদের মনে আতঙ্ক রয়ে গেছে। ঝড় উঠলেই আজান চাচার গায়ে আঁকড়ে ধরে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি দ্রুত শিশুদের জন্য অভিযোজন ব্যবস্থা, মানসিক সহায়তা এবং জাতীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না হয়, তবে পাকিস্তান এমন এক প্রজন্ম তৈরি করবে, যাদের পরিচয় হবে ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ, সম্ভাবনায় নয়।