‘বাংলাদেশের বন্ড ও সুকুক বাজার উন্মোচন’ সেমিনারে নীতিনির্ধারক, নিয়ন্ত্রক ও শিক্ষাবিদদের বক্তব্যে একটি বার্তাই সবচেয়ে জোরালো হয়ে উঠেছে—সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন আটকে যাবে; আর টেকসই অর্থের উৎস জোগাতে কর-রাজস্ব বাড়ানো, ব্যাংকনির্ভরতা কমানো এবং পুঁজিবাজারনির্ভর দীর্ঘমেয়াদি তহবিল গড়া—এই তিনটি কাজ একসঙ্গে এগোতে হবে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের ভাষায়, “টাকা কোথায়”—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কর-রাজস্বের গলার কাঁটা: ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত
বাংলাদেশের ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত শতাংশের ঘরে আটকে আছে, যেখানে ব্রাজিলে তা শতাংশ। সংখ্যার এই ব্যবধান কেবল সংগ্রহক্ষমতার দুর্বলতা নয়; এটি কর-নীতি, কর-প্রশাসন, করদাতার আস্থা এবং সেবার মান—সবকিছুর সম্মিলিত প্রতিফলন। অনেক দেশে নাগরিকরা বেশি কর দিয়ে দৃশ্যমান জনসেবা পায়—পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা; ফলে ‘ট্যাক্স-সেবা চুক্তি’ দৃঢ় হয়। আমাদের ক্ষেত্রে কর দিলেও সেবায় ঘাটতি অনুভূত হওয়ায় করদাতার মনস্তত্ত্বে ‘ফ্রি-রাইডার’ প্রবণতা জেগে ওঠে, যা রাজস্বভিত্তি প্রসারণকে ধীর করে।
নীতি-পাঠ: ট্যাক্স নেট প্রসারণ (ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান), ভ্যাট আদায়ের দক্ষতা, রিটার্ন দাখিলের ই-পরিসরকে ঝামেলামুক্ত করা এবং উচ্চঝুঁকির খাতে এনালিটিক্সনির্ভর অডিট জোরদার—এগুলো একসঙ্গে না হলে – শতাংশে আটকে থাকা অনুপাতকে ‘ডাবল ডিজিট’-এ নেওয়া কঠিন।
ব্যাংকনির্ভরতার সীমাবদ্ধতা: এএলএম মিসম্যাচ থেকে সিস্টেমিক ঝুঁকি
বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এখনো প্রধানত ব্যাংকঋণনির্ভর। কিন্তু ব্যাংকের তহবিল স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি আমানত থেকে আসে; দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো বা ক্যাপেক্স অর্থায়নে এতে ‘অ্যাসেট–লাইয়াবিলিটি মিসম্যাচ’ (ALM) হয়, যা সুদের সংবেদনশীলতা, তারল্যচাপ ও পুনঃঅর্থায়নের ঝুঁকি বাড়ায়। বড় প্রকল্পে ধারাবাহিক কিস্তি ছাড়ে বিলম্ব হলে ব্যাংকিং খাতে ‘ক্রেডিট কনসেন্ট্রেশন’ও তৈরি হয়—এক–দুইটি সেক্টরের বিপদ গোটা ব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
নীতি-পাঠ: ব্যাংককে মধ্যমেয়াদি চলতি মূলধন, এসএমই ও ভোক্তা ঋণে তুলনামূলক ফোকাস দিয়ে, দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পকে পুঁজিবাজারে ‘হস্তান্তর’ (risk transfer) করার সময় এসেছে।
পুঁজিবাজার, সুকুক ও বন্ড: দীর্ঘমেয়াদি টাকার প্রাতিষ্ঠানিক পথ
বাংলাদেশে সুকুকের বাজার আকার হাজার কোটি টাকার বেশি; তবে এর বড় অংশ সরকারি প্রকল্পে। বেসরকারি খাত সুকুক—বিশেষত ‘অ্যাসেট–ব্যাকড’ ও ‘প্রজেক্ট–ভিত্তিক’ কাঠামো—ব্যবহার করলে খরচ–প্রতিযোগী দীর্ঘমেয়াদি তহবিল পাবে। একই সঙ্গে কর্পোরেট বন্ড, প্রজেক্ট বন্ড ও গ্রিন বন্ড—এই তিনটি ‘পাইপ’ খুলতে পারলে অবকাঠামো, জ্বালানি, নবায়নযোগ্য, লজিস্টিকস ও সামাজিক খাতে (হাসপাতাল/শিক্ষা) ফান্ডিংয়ের নতুন জানালা মিলবে।
নীতি-পাঠ: ইস্যুর অনুমোদন–সময় কমানো, রেটিং–স্ট্যান্ডার্ড সুস্পষ্ট করা, ট্রাস্টি–ব্যবস্থাকে পেশাদার করা, ট্যাক্স ট্রিটমেন্টের স্বচ্ছতা ও সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেনের সুবিধা—এই চারটি জায়গা শক্ত করলে বাজারের গভীরতা বাড়বে।
সিকিউরিটাইজেশন: এমআরটি–ধাঁচের প্রকল্পে ‘ফিউচার ক্যাশফ্লো’কে সম্পদে রূপ
এমআরটি বা বড় ইউটিলিটি প্রকল্পে ভবিষ্যৎ টিকিট/ট্যারিফ আয়ের ওপর ভিত্তি করে সিকিউরিটাইজেশন করলে বন্ড বা সুকুকের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল তোলা যায়—রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির চাপও কমে। প্রকল্পের কনসেশন এগ্রিমেন্টে রাজস্ব–বণ্টন সূত্র, ট্যারিফ রিভিউয়ের টাইমটেবিল ও কর্মক্ষমতা–সূচক (KPI) লিখে দিলে বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি–মূল্যায়ন সহজ হয়।
নীতি-পাঠ: ‘রেভিনিউ বন্ড’ বা ‘ইনভেস্টর–প্রটেকশন ক্লজ’সহ স্ট্যান্ডার্ড ডকুমেন্ট টেমপ্লেট দ্রুত জারি করুন—প্রকল্পপ্রধানরা যেন পুনরাবিষ্কার না করে, বরং প্রস্তুত ব্লুপ্রিন্ট নিয়ে বাজারে আসতে পারেন।
সামাজিক নিরাপত্তা: অর্থ জোগানই নয়, ফলপ্রসূ ব্যয়ের নিশ্চয়তা
অর্থ উপদেষ্টার পর্যবেক্ষণ—যথেষ্ট রাজস্ব না থাকলে সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ দেওয়া যায় না—ঠিক। তবে বরাদ্দ পেলেই সমাধান নয়; লক্ষ্যভিত্তিকতা, লিকেজ নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল যাচাইকরণ (ভাউচার/ডিবিটি) এবং ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরের বছরের বাজেট–অ্যালোকেশন নির্ধারণ—এসব নিশ্চিত করতে হবে।
নীতি-পাঠ: সামাজিক নিরাপত্তায় ‘আউটকাম–বেইসড বাজেটিং’ (শিশু অপুষ্টি হ্রাস, ড্রপআউট কমানো, মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন ইত্যাদি) চালু হলে টাকা কেবল খরচই হবে না; পরিমাপযোগ্য ফলও আসবে।
‘ট্যাক্স–সেবা চুক্তি’: কর–নীতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনার তিন ধাপ
দৃশ্যমান সেবা বিনিময়: ট্যাক্স–ফান্ডেড প্রকল্পে পাবলিক ড্যাশবোর্ড—কোথায় কত ব্যয় হলো, কী ফল এলো—এমন স্বচ্ছতা করদাতাকে ‘রিটার্ন’ অনুভব করায়।
ন্যায্যতা ও সরলতা: কর হার হালনাগাদে ধারাবাহিকতা, অপ্রত্যাশিত ‘রেট–শক’ এড়ানো, এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য প্রিসাম্পটিভ/টার্নওভার ট্যাক্সের যুক্তিসংগত কাঠামো।
প্রশাসনিক দক্ষতা: ই–ফাইলিং ও ই–পেমেন্টে ওয়ান–ক্লিক অভিজ্ঞতা, ঝুঁকিভিত্তিক অডিট; একই সঙ্গে ‘হাই–রিস্ক সেক্টর’ ও উচ্চ আয়ের অদৃশ্য খাতে (উদাহরণ: নির্দিষ্ট সেবা–পেশা) ডেটা–ম্যাচিং।
সম্ভাব্য আপত্তি ও জবাব
আপত্তি: সুকুক/বন্ড বাজার ছোট; চাহিদা কোথায়?
জবাব: বীমা, পেনশন, মিউচুয়াল ফান্ড—এই ‘ন্যাচারাল লং–টার্ম ইনভেস্টর’দের জন্য গ্রেডেড, নিয়মিত কুপন–আয়কারী ইন্সট্রুমেন্ট আকর্ষণীয়। স্থিতিশীল নিয়ম–কানুন ও রেটিং–শৃঙ্খলা থাকলে চাহিদা গড়ে ওঠেই।
আপত্তি: সিকিউরিটাইজেশন জটিল; প্রকল্প ঝুঁকি কে নেবে?
জবাব: ঝুঁকি ‘স্ট্রাকচার’ দিয়ে ভাগ করা যায়—সিনিয়র/মেজানাইন/ইকুইটি ট্র্যাঞ্চ, ক্রেডিট এনহান্সমেন্ট, রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট এবং পারফরম্যান্স কভেন্যান্ট। বিনিয়োগকারীরা জানুক—কোন ঝুঁকির জন্য কত রিটার্ন।
আপত্তি: কর বাড়ালে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত।
জবাব: লক্ষ্য হার বাড়ানো নয়; ভিত্তি প্রসারণ ও প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো। পাল্টা হিসেবে সরবরাহ–পক্ষ সহায়তা (দ্রুত অবচয় সুবিধা, প্রজেক্ট বন্ডে কর–প্রণোদনা, গবেষণা–উন্নয়নে ট্যাক্স ক্রেডিট) দেওয়া যেতে পারে।
নীতিপ্যাকেজ: এখনই যা করা যায়
• রাজস্বভিত্তি শক্তিশালীকরণ: উচ্চ সম্ভাবনাময় খাতে (ডিজিটাল সেবা, পেশাজীবী, ভ্যাট–গ্যাপ) ‘রিস্ক অ্যানালিটিক্স সেল’; রিটার্ন দাখিলে প্রি–ফিলড ফর্ম; ঘনঘন ট্যাক্স অ্যামনেস্টি থেকে বিরত থাকা।
• বন্ড/সুকুক মার্কেট ডীপেনিং: ইস্যু অনুমোদনে SLA (service level agreement), রেটিং–স্ট্যান্ডার্ডের কমন ট্যাক্সোনমি, ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে রিটেইল অংশগ্রহণের সহজ উপায়।
• সিকিউরিটাইজেশন ফ্রেমওয়ার্ক: এমআরটি ও ইউটিলিটি প্রকল্পের জন্য স্ট্যান্ডার্ড কনসেশন/ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম; আর্থিক ক্লোজারের আগে ‘ইনভেস্টর প্রিভিউ’ আয়োজন।
• ব্যাংকিং চাপ কমানো: দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে ব্যাংকঋণের ‘টেক–আউট ফাইন্যান্সিং’ ব্যবস্থা—প্রকল্প চালু হলে বন্ড/সুকুক দিয়ে ব্যাংকের এক্সপোজার ধীরে ধীরে কমানো।
• সামাজিক নিরাপত্তায় ফল–ভিত্তিক বাজেটিং: ইউনিক আইডি/ডিবিটি, লিকেজ অডিট এবং বরাদ্দ–পুনর্বিন্যাসে আউটকাম সূচকের বাধ্যবাধকতা।
• বিশ্বাস–গঠনের যোগাযোগ: কর দিয়ে যে সেবা মিলছে—এটি দৃশ্যমান করতে ‘করদাতা পোর্টাল’, জেলা–ওয়ারি প্রকল্প–মানচিত্র ও ত্রৈমাসিক ফলাফল–রিপোর্ট প্রকাশ।
মানবসম্পদে বিনিয়োগের টেকসই সঞ্চালন–চক্র
সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগ কেবল ব্যয় নয়—এটি ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতার বীজতলা। ট্যাক্স–টু–জিডিপি অনুপাতকে ধাপে ধাপে ‘ডাবল ডিজিট’–এ তোলা, ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি তহবিলের চ্যানেল খোলা এবং এমআরটি–ধাঁচের প্রকল্পে সিকিউরিটাইজেশন—এই তিনটি ধারাকে সমান্তরালে এগোতে হবে। নীতিগত স্বচ্ছতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও বিনিয়োগকারীর আস্থা—এই ত্রয়ী মিললে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি—দুই খাতেই লং–টার্ম ক্যাপিটালের দরজা খুলবে। এর ফলশ্রুতি হবে সেবার মানোন্নয়ন—শিক্ষক–চিকিৎসকের সম্মানজনক বেতন থেকে শুরু করে নিরাপদ জনপরিবহন, আধুনিক হাসপাতাল ও কর্মসংস্থানের প্রসার—যা শেষ পর্যন্ত সামাজিক নিরাপত্তার লক্ষ্যকেই বাস্তব অর্থে অর্থবহ করে তুলবে।