ইন্দোনেশিয়ার কৃষি-প্রযুক্তি টানিহাব ও জ্যাকুয়া-টেক ইফিশারিকে ঘিরে দুর্নীতি ও হিসাব জালিয়াতির ঘটনা দেশটির স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা স্পষ্ট করেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেমে যাওয়ায় তহবিল সংকুচিত, বিশেষ করে লেট-স্টেজ কোম্পানিগুলোর জন্য। সরকার ও খাতভিত্তিক সংগঠনগুলো নীতিগত রোডম্যাপ দিলেও সাম্প্রতিক উচ্চপ্রোফাইল মামলা সংকটের গভীরতা দেখাচ্ছে। তবু শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসন কাঠামো দেখাতে পারা কিছু প্রতিষ্ঠান—যেমন ফিনটেক আমার্থা—এখনও আন্তর্জাতিক অর্থায়ন টানছে।
কেন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ
- • দুর্নীতি ও ভুয়া আর্থিক রিপোর্টিং বিনিয়োগকারীদের ভরসা নষ্ট করছে।
- • ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় বড়ভাবে কমেছে।
- • লেট-স্টেজ ফান্ডিং প্রায় থমকে; এক্সিট ও স্কেল-আপের সুযোগ সংকুচিত।
- • শাসন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ডিউ ডিলিজেন্সের ঘাটতি এখন খাতের কেন্দ্রীয় সমস্যা।
টানিহাব কেস: রাষ্ট্রায়ত্ত ভিসি ইউনিটের ছায়া
জাকার্তার প্রসিকিউটররা টানিহাব-সংশ্লিষ্ট প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং মামলায় তিনজনকে প্রকাশ্যে হাজির করেন। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ভিসি ইউনিট—বিআরআই ভেঞ্চারস (ব্যাংক রাখ্যাত ইন্দোনেশিয়া) ও এমডিআই ভেঞ্চারস (টেলকম ইন্দোনেশিয়া)—এর সাবেক কর্মকর্তাদের নাম উঠে আসে।
- • সন্দেহভাজন: নিকো উইদজাজা (সাবেক সিইও, বিআরআই ভেঞ্চারস), উইলিয়াম গোজালি (সাবেক হেড অব ইনভেস্টমেন্ট, বিআরআই ভেঞ্চারস), আলদি আদ্রিয়ান হার্তান্তো (সাবেক ভিপি-ইনভেস্টমেন্ট, এমডিআই)।
- • আগেই গ্রেপ্তার: ইভান আরিয়ে সেতিয়াওয়ান (সাবেক সিইও, টানিহাব), এডিসন টোবিং (সাবেক বোর্ড সদস্য), ডোনাল্ড উইহারজা (সাবেক সিইও, এমডিআই ভেঞ্চারস)।
ইফিশারি কেলেঙ্কারি: পাঁচ গুণ ফুলিয়ে-ফাঁপানো রাজস্ব
এক হুইসেলব্লোয়ারের অভিযোগের পর বিনিয়োগকারীদের নির্দেশে ফরেন্সিক অডিটে দেখা যায়—২০২৪ সালের জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর সময়ে ইফিশারি রাজস্ব পাঁচ গুণ বেশি দেখিয়েছে।
- • পুলিশি তদন্তে সন্দেহভাজন: গিবরান হুজাইফা আমসি এল ফরিজি (প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সিইও), আঙ্গা হাদ্রিয়ান রাদিত্য (সাবেক ভিপি), আন্দ্রি ইয়াদি (সাবেক ভিপি, অ্যাকুয়াকালচার ফাইন্যান্সিং)।
বিনিয়োগে ধস: সংখ্যার ভাষায় সংকট
ডিলস্ট্রিটএশিয়ার হিসাবে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ইন্দোনেশিয়ায় ভিসি অর্থায়ন মাত্র ৮০ মিলিয়ন ডলার—২০২৪ সালের একই সময়ের ২০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বড় পতন।
- • ২০২৪ সালের পুরো বছর: ৪৪০ মিলিয়ন ডলার—২০২১ সালের ৯.৪৪ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৯৫% কম।
- • টাকার বেশিরভাগ গেছে আর্লি-স্টেজে; ২০২৫ সালে লেট-স্টেজ প্রায় শূন্য।
- • দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হয়েও বিনিয়োগে ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইনসহ প্রতিবেশীদের পেছনে—যেখানে কিছু বছর আগেও গোটু গ্রুপ ও ট্রাভেলোকা বিলিয়ন-ডলারের ভ্যালুয়েশন তুলত।
বিশেষজ্ঞদের মত: মূল রোগ ‘শাসন’
সাবেক আইসিটি মন্ত্রী রুদিয়ানতারা বলেন, “এটা স্টার্টআপদের জেগে ওঠার ডাক। খারাপ শাসন ‘টেক উইন্টার’কে গভীর করেছে; লেট-স্টেজে টাকার সংকট তৈরি।”
ইন্দোজেন ক্যাপিটালের ম্যানেজিং পার্টনার চান্দ্রা ফিরমান্তো মনে করেন, বুম-পর্বে ডিউ ডিলিজেন্স কমিয়ে আনা হয়েছিল—এখনকার কেলেঙ্কারিগুলো বিনিয়োগ সম্প্রদায়ের জন্য “শক থেরাপি”; ফান্ডগুলো পোর্টফোলিও গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে।
শাসন-উন্নয়নের গাইড: ‘ম্যাচুরিটি ম্যাপ’
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিসি সমিতিগুলো ২০২৫ সালের এপ্রিলে একটি ‘ম্যাচুরিটি ম্যাপ’ দেয়—ইকোসিস্টেমে শাসন জোরদারের নির্দেশিকা হিসেবে। নথির মূল কথা: দ্রুত-বর্ধনশীল প্রাইভেট ক্যাপিটাল ইকোসিস্টেমে দুর্বল শাসন বিনিয়োগপ্রবাহ ও ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে অগ্রগতি ধীর হয়।
বড় হওয়া থেকে ভাঙন: ইফিশারি ও টানিহাব
গত দশকে দুই স্টার্টআপই উদ্ভাবনী মডেলে দ্রুত বড় হয়।
- • ইফিশারি: শীর্ষ মূল্যায়ন ১.৪ বিলিয়ন ডলার; কর্মী ~২,০০০।
- • টানিহাব: দুই রাউন্ডে ৮১.৫ মিলিয়ন ডলার; দাবি—১.১০ লাখ কৃষক ও ৩.৫০ লাখ ভোক্তাকে সেবা; ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট ডিবেটে প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর প্রশংসা পায়।
শেষতক, শাসনগত দুর্বলতা ও ঝুঁকি-নিয়ন্ত্রণে গাফিলতি বিস্ফোরণের জায়গা তৈরি করে।
বিনিয়োগকারীদের করণীয়: শুধু টপলাইন নয়
সিইএলআইওএসের বিশ্লেষক নাইলুল হুদা বলেন, বিনিয়োগকারীদের ‘হ্যান্ডস-অন’ হতে হবে—শুধু আর্থিক ফলাফলে নয়, মডেলের মিশন ও সময়সাপেক্ষতাও দেখতে হবে।
- • উদাহরণ: ইফিশারির ব্যাংকঋণ (এইচএসবিসি, ওসিবিসি এনআইএসপি, ডিবিএস) থাকলেও স্টার্টআপে লাভজনকতা সাধারণত দেরিতে আসে; তাই স্বল্পমেয়াদি ‘প্রফিটেবল গ্রোথ’ চাপ আগাম সতর্ক সংকেত হতে পারত।
রেড ফ্ল্যাগ: দীর্ঘস্থায়ী ক্যাশ-বার্ন
আমভেসিন্দোর চেয়ারম্যান এদি দানুসাপুত্রো সতর্ক করেন, কোনো স্টার্টআপ যদি ৫–৭ বছর টানা ক্যাশ বার্ন করে, তা অস্বাস্থ্যকর—মূল ব্যবসা-মডেলে সমস্যা থাকার ইঙ্গিত।
রেগুলেটরের অবস্থান ও রোডম্যাপ
আর্থিক সেবা কর্তৃপক্ষ ওজেকে বলেছে, ইফিশারি-টানিহাব গোটা শিল্পের চিত্র নয়। ২০২৪ সালে তারা ভিসি সেক্টরের জন্য ৫ বছরের রোডম্যাপ দিয়েছে—যার প্রথম স্তম্ভ শাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। লক্ষ্য—সুস্থ প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্টার্টআপ/এমএসএমই অর্থায়ন, ভোক্তা সুরক্ষা, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে অবদান। তবে দ্বিতীয় বছরেই এমডিআই ও বিআরআই ভেঞ্চারস-সংশ্লিষ্ট মামলা কাঠামোগত দুর্বলতা সামনে এনেছে।
ভালো চর্চার উদাহরণ: আমার্থা
১৫ বছরের মাইক্রোফাইন্যান্স-কেন্দ্রিক ফিনটেক আমার্থার সিইও আন্দি তাউফান গারুদা পুত্রা বলছেন, নেতৃত্বের সততা থেকেই শাসনের শুরু।
- • শুরু থেকেই গ্রামীণ নারীদের নেতৃত্বাধীন মাইক্রো/ক্ষুদ্র/মাঝারি ব্যবসায় অর্থায়নের মিশনে অটল।
- • ৩৫ ট্রিলিয়ন রুপিয়াহ ঋণ বিতরণ, ৩৩ লাখ গ্রাহক।
- • আক্রমণাত্মক ক্যাশ-বার্ন এড়িয়ে ক্যাশফ্লো-সামর্থ্য মেনে টিম, টেক ও মার্কেটিংয়ে বিনিয়োগ।
- • ২০২৫ সালের জুনে সুইডফান্ড, ফিনফান্ড, ও বেলজিয়ামের বিআইও থেকে ৫৫ মিলিয়ন ডলার—যা বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আইএফসি-তত্ত্বাবধানে ১৯৯ মিলিয়ন ডলারের সিন্ডিকেটেড ঋণের অংশ।
রুদিয়ানতারা (আমার্থার প্রেসিডেন্ট কমিশনার) মনে করেন, দ্রুতগতির সম্প্রসারণ নয়—ধারাবাহিক ব্যবসা-বিকাশে মনোযোগ তাদের স্থিতি এনেছে। টানিহাবের দ্রুত পিভটের বিপরীতে আমার্থা এক দশক ভিত শক্ত করে তারপর প্রসারিত হয়; সদ্য নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেম ও ই-ওয়ালেট চালু করেছে।
ম্যাক্রো চাপ: ‘লম্বা শীত’ আর কতদিন
দানুসাপুত্রো ও ফিরমান্তোর বিশ্লেষণ, বৈশ্বিক উচ্চ সুদের যুগ—বিশেষত ফেডের কড়া নীতি—উদীয়মান অর্থনীতিতে পুঁজিপ্রবাহে বাধা।
- • এখন বিনিয়োগে শুধু টপলাইন নয়—লাভের পথ, স্থায়িত্ব, শাসন ও ঝুঁকি-ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
- • বিনিয়োগকারীদের কাছে এক্সিট-রুট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—“ইনভেস্ট করা সহজ, ডিভেস্ট করা কঠিন।”
- • ভিসিদের কাছে অর্থ আছে; কিন্তু তারা শক্ত লেট-স্টেজ ডিল খুঁজছে—যেখানে ক্যাশ-ক্রাঞ্চে পড়া কোম্পানি টেকসই সহায়তা চাইছে।
টাকা আসতে পারে কোথা থেকে
ধীর প্রবৃদ্ধি ও জনসংখ্যা সংকোচনে থাকা উন্নত অর্থনীতি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফান্ডের প্রবাহ বাড়ছে; বড় বাজার হিসেবে ইন্দোনেশিয়া নজরে।
- • বিশেষ করে হংকং চীনা তহবিলের ফানেল হিসেবে কাজ করছে; দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকেও অর্থ আসছে—ফিরমান্তোর পর্যবেক্ষণ।
এখন কী দরকার (রোডম্যাপ টু রিকভার)
- • বোর্ড ও বিনিয়োগকারীর সক্রিয় তদারকি: নির্দিষ্ট সময় পরপর ফরেন্সিক রিভিউ, ইএসজি ও কমপ্লায়েন্স চেক।
- • স্বচ্ছতা ও রিপোর্টিং: রাজস্ব স্বীকৃতি, ঋণচুক্তি ও গ্রাহকসংখ্যা যাচাইযোগ্য করা।
- • বাস্তববাদী ব্যবসা-মডেল: দ্রুত স্কেলের বদলে লাভজনকতার পরিষ্কার রূপরেখা।
- • রেগুলেটরি সমন্বয়: ওজেকের রোডম্যাপকে বাধ্যতামূলক মেট্রিক ও শাস্তিমূলক কাঠামো দিয়ে কার্যকর করা।
টানিহাব ও ইফিশারির কেলেঙ্কারি দেখিয়ে দিয়েছে—শাসনঘাটতি কত বড় মূল্য চাপাতে পারে। ফান্ডিং সংকোচন সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে লেট-স্টেজ স্টার্টআপে, যেখানে এক্সিটও কঠিন। তবে আমার্থার উদাহরণ বলছে—কঠোর শাসন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও মিশন-নির্ভর বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারলে আন্তর্জাতিক অর্থ এখনও পাওয়া যায়। এই ‘শীত’ কাটাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দীর্ঘমেয়াদি শৃঙ্খলার বিকল্প নেই।