দশম পরিচ্ছেদ
সান্ধ্যপ্রার্থনার জন্যে গির্জের ঘণ্টা বাজতে শুরু করলে কসাকটা তার তরোয়াল চালানো অভ্যেস করা বন্ধ করলে। গরম-হয়ে-ওঠা তরোয়ালের ফলাটা ছাইরঙের একটা পায়ের পট্টি দিয়ে মুছে খাপে পুরে ফেলে নিজের বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকলে। লোকটা তখনও হাঁপাচ্ছে আর জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে।
আলুখেতের মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে-চলার পথ ধরে এক সময়ে একটা ঝরনার ধারে এসে হাজির হলুম। পুরনো, শ্যাওলাঢাকা একটা কাঠের গুড়ির ফাঁক দিয়ে বরফের মতো ঠাণ্ডা কঙ্কনে জল প্রাণের আনন্দে ফেনিয়ে-ফেনিয়ে ঝরে পড়ছিল। পাশেই পচা কাঠের ক্রুশে-বসানো মরচে-ধরা একটা যিশুমূর্তি মলিন-হয়ে-আসা চোখে তাকিয়ে ছিল। মূর্তিটার নিচে কাঠের গায়ে ছুরি-দিয়ে খোদাই-করা কয়েকটা কথা তখন ঝাপসা হয়ে এসেছিল। কথাগুলো এই: ‘দেবদেবীর যত মূর্তি আর সন্তরা সবই ধাস্পা!’
অন্ধকার হয়ে আসছিল। ভাবছিলুম, ‘আর আধঘণ্টার মধ্যেই ইটের-তৈরি কাড়েটার দিকে যেতে পারব।’ ঠিক করলুম, গ্রামের একেবারে প্রান্তে চলে যাব, তারপর বড় রাস্তা পার হয়ে সেখান থেকে ছোট একটা পাশের পথ ধরে গরাদ-দেয়া সেই জানলাটার দিকে এগোব। আমার মাওজারটা ঝোপের মধ্যে কোথায় ফেলেছিলুম তা আমার ঠিক-ঠিক জানা ছিল।
ফেলবার পরে দেখেছিলুম, শাদা কাগজের মোড়কটা বিছুটির ফাঁক দিয়ে অল্প-অল্প দেখা যাচ্ছিল। আমি পরিকল্পনা ছকে ফেললুম: রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে না-থেমেই মাওজারটা তুলে নেব, তারপর জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে সেটা ভেতরে গলিয়ে দিয়ে যেন কিছুই হয় নি এমনভাবে সোজা হে’টে চলে যাব।
রাস্তার মোড় ফিরতেই একটুকরো পোড়ো গো-চর জমিতে এসে পড়লুম। দেখলুম, মাঠটায় একদল সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। আর, তারপর, হঠাৎ ক্যাটেনের একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলুম।
‘এখানে কী মনে করে?’ অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন বলল। ‘তুমিও দেখতে এসেছ নাকি? ব্যাপারটা তোমার কাছে নতুন, তাই না?’
‘আপনি এর মধ্যে ফিরে এসেছেন?’ ভ্যাবাচাকা খেয়ে ওর দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আমি জড়িয়ে-জড়িয়ে বললুম। এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম যে ওর কথার মানে ধরতে পারছিলুম না।
হঠাৎ ডানদিকে উ’চুগলার একটা হুকুম শুনে দু-জনেই আমরা ফিরে তাকালুম। আর যা দেখলুম তাতে ভুত দেখার মতো আঁতকে উঠে আমি ক্যাটেনের জামার হাতাটা চেপে ধরলুম।