আফ্রিকার বাজারে সিঙ্গাপুর কোম্পানির আকর্ষণ
আফ্রিকা এখন সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার ভূমি হয়ে উঠছে। মহাদেশটির রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে তরুণ জনগোষ্ঠী, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ভাণ্ডার। এ কারণে দ্রুত বর্ধনশীল ভোক্তা বাজারকে কাজে লাগাতে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানগুলো আফ্রিকার দিকে ঝুঁকছে।
বর্তমানে ১০০-রও বেশি সিঙ্গাপুর কোম্পানি আফ্রিকায় ব্যবসা করছে। কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ভোক্তা পণ্য, বীমা, ফিনটেক, এমনকি বন্দর ও বাণিজ্য অবকাঠামোতেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে।
প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বিনিয়োগ
উইলমার ইন্টারন্যাশনাল দুই দশকের বেশি সময় ধরে আফ্রিকায় তেল, সাবান ও ডিটারজেন্ট উৎপাদন করছে। টোলারাম গ্রুপ আফ্রিকার ঘরে ঘরে পরিচিত ‘ইন্দোমি’ নুডলস সরবরাহ করছে। পাশাপাশি তারা নাইজেরিয়ায় বিশাল ফ্রি ট্রেড জোন ও গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করছে।
এমবেড ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ ২০২৪ সালের মার্চে আফ্রিকার বাজারে প্রবেশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডেনিস এনজি বলেন, শুরুতে মানুষ ভাবত তিনি হয়তো সাফারিতে যাচ্ছেন। আসলে তারা আফ্রিকায় সাধারণ মানুষের কাছে বীমা ও আর্থিক প্রযুক্তি পৌঁছে দিচ্ছেন।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বৃদ্ধি
সিঙ্গাপুর ও আফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্য ২০২০ সালে ১২.১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ বিলিয়ন ডলারে। সিঙ্গাপুর আফ্রিকার শীর্ষ ১০ বিনিয়োগকারীর একটি হলেও এখনো তার উপস্থিতি আসিয়ান, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ছোট।
চ্যালেঞ্জ ও অগ্রগতি
দীর্ঘদিন আফ্রিকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল অবকাঠামো ও জটিল নিয়মকানুন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নাইজেরিয়ার মুদ্রা নায়রার পতন এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও সীমিত হয়ে পড়েছিল।
তবুও সাম্প্রতিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের সুযোগ নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। বিশেষ করে আফ্রিকার তরুণ জনগোষ্ঠী এবং ক্রমবর্ধমান শহুরে জীবনধারা ব্যবসার জন্য সম্ভাবনা তৈরি করছে।
ঘানার ২৪ ঘণ্টার অর্থনীতি
২০২৫ সালের আগস্টে ঘানার প্রেসিডেন্ট জন ড্রামানি মাহামা সিঙ্গাপুর সফরে এসে ঘোষণা দেন, “ঘানা ২৪ ঘণ্টা ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত।” সফরে তিনি খাদ্য ও কৃষি পণ্য খাতে ওলম গ্রুপের কাছ থেকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ নিশ্চিত করেন। এই অর্থে পশুখাদ্য প্রক্রিয়াকরণসহ বিভিন্ন প্রকল্প চালু হবে।
আফ্রিকান ফ্রি ট্রেড এরিয়া ও ব্যবসার সহজীকরণ
২০২১ সালে চালু হওয়া আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া সিঙ্গাপুর ব্যবসার জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। এখন একটি দেশে প্রবেশ করলে আশপাশের দেশগুলোতেও সম্প্রসারণ সহজ হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রায় আন্তঃসীমান্ত লেনদেনের ব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি কমিয়েছে।
আফ্রিকার শহরগুলোতেও পরিবর্তন স্পষ্ট। ঘানার রাজধানী আক্রা একসময় গ্রাম্য পরিবেশের মতো হলেও এখন শপিং মল, সিনেমা হল ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাইরোবির ক্যাফেতে ল্যাপটপে কাজ করা তরুণ আফ্রিকানদের জীবনযাত্রা এখন এশিয়ার শহরগুলোর মতোই।
অবকাঠামোগত চাপ ও কোম্পানির ভূমিকা
তবে গ্রামীণ এলাকা থেকে লাখো মানুষের শহরে আসায় অবকাঠামোর ওপর চাপ বেড়েছে। নাইজেরিয়ায় পণ্য পরিবহনে যানজট বড় সমস্যা। ভ্যালেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান বাণিজ্য কর্মকর্তা প্রিয়াঙ্কা জৈন বলেন, “আমরা সমস্যা নিয়ে অভিযোগ না করে সমাধানে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করি। বিদেশি কোম্পানিকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে।”
ভ্যালেন্সি আফ্রিকায় বাদাম, শস্য, কোকোসহ বহুমুখী কৃষি ব্যবসা করছে এবং স্থানীয় কৃষক ও নারীদের সঙ্গে কাজ করতে আন্তর্জাতিক তহবিল পেয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
সিঙ্গাপুরের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি ও খনিজ খাতে বেশি সক্রিয় হলেও ফিনটেক, সবুজ অর্থনীতি ও দ্রুত বিক্রিত ভোক্তা পণ্যেও নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে। আফ্রিকার লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ স্বচ্ছ জ্বালানি প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।
সিঙ্গাপুর বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধাতু ও কৃষিপণ্য বাণিজ্য কেন্দ্র। ফলে বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে আফ্রিকার সাথে তার অর্থনৈতিক সম্পর্কও জোরদার হচ্ছে। তবে আফ্রিকার খনিজ সম্পদ এখন যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রতিযোগিতার নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, যেখানে উভয় দেশই প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত।
আফ্রিকা এখনও চ্যালেঞ্জপূর্ণ দ্রুত বর্ধনশীল ভোক্তা বাজার, প্রাচুর্য খনিজ সম্পদ ও তরুণ জনগোষ্ঠী সিঙ্গাপুরসহ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে। সঠিক কৌশল ও অবকাঠামো উন্নয়ন হলে আফ্রিকা আগামী দশকে আন্তর্জাতিক ব্যবসার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।