দুর্গাপূজা বাঙালির জীবনে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক মহোৎসব—সামাজিক মিলন, আনন্দ আর সাজগোজের অনন্য উপলক্ষ। আর এই উৎসবের সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দেয় শাড়ি। বিশেষ করে পূজার শাড়ি যেন হয়ে উঠেছে নারীর সাজের অপরিহার্য অংশ। বাংলাদেশের তৈরি শাড়ি এখন কেবল দেশের বাজারেই নয়, সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতা এবং প্রবাসী বাঙালির মধ্যেও সমান জনপ্রিয়। ঐতিহ্যবাহী তাঁতের কারুকাজ থেকে শুরু করে আধুনিক ডিজাইন—সব মিলিয়ে “Made in Bangladesh” পূজার শাড়ি আজ এক বিশেষ পরিচয় পেয়েছে।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশের শাড়ি শিল্পের ইতিহাস দীর্ঘ ও গৌরবময়। মসলিন ও জামদানির নাম বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। পূজার শাড়ির মূল রঙ লাল-সাদা হলেও, সময়ের সাথে যুক্ত হয়েছে নানা ধরণের সৃজনশীলতা। কারুকাজে উঠে এসেছে আলপনা, পদ্মফুল, দুর্গামূর্তি কিংবা শঙ্খের নকশা। এভাবে পূজার আবেগ, ধর্মীয় প্রতীক এবং নারীর ব্যক্তিত্ব সবকিছুরই প্রতিফলন ঘটছে এক টুকরো শাড়িতে।
তাঁতের অবদান
টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী ও পাবনার তাঁতিরা পূজার মৌসুমকে ঘিরে বিশেষ নকশা তৈরি করেন। তাঁতশিল্পীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শাড়িকে শুধু পোশাক নয়, শিল্পের রূপ দিয়েছেন। পূজার আগে এই তাঁতিদের কারখানায় ব্যস্ততা বেড়ে যায়, কারণ দেশের বড় ব্র্যান্ড এবং বুটিকগুলো তাদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করে পূজার কালেকশন। এতে কর্মসংস্থান বাড়ে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।

বেইলি রোড : পূজার শাড়ির প্রাণকেন্দ্র
ঢাকার বেইলি রোড একসময় নাটক আর সংস্কৃতির জন্য পরিচিত হলেও, এখন এটি পূজার শাড়ির অন্যতম বাজার। এখানে অসংখ্য বুটিক হাউস ও ফ্যাশন দোকানে পূজার আগে ভিড় জমে। নারীরা দল বেঁধে আসেন নতুন ডিজাইনের তাঁতের, সিল্ক, কটন ও জর্জেটের শাড়ি কিনতে। দোকানগুলোতে লাল-সাদা থেকে শুরু করে সোনালি-সবুজ কিংবা রূপালি ঝলমলে শাড়ি পাওয়া যায়। পূজার আগে বেইলি রোডে হাঁটলে মনে হয়, এটি যেন উৎসবেরই অংশ—আলো, সজ্জা আর রঙিন পোশাকের ছটা।
আড়ং : ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
বাংলাদেশের অন্যতম ব্র্যান্ড আড়ং পূজার শাড়িকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন করে পরিচিত করেছে। আড়ং-এর পূজার কালেকশনে থাকে জামদানি, কটন, সিল্ক, ব্লক প্রিন্ট ও হাতে এমব্রয়ডারি করা শাড়ি। শুধু লাল-সাদা নয়, এখানে থাকে বিভিন্ন রঙের চমৎকার ব্যবহার—আকাশি, মেরুন, সোনালি কিংবা অফ-হোয়াইট। আড়ং-এর শাড়ি তরুণীদের মতো বয়স্ক নারীর কাছেও সমান জনপ্রিয়। সবচেয়ে বড় কথা, আড়ং তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে এই শাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা টরন্টোতে থাকা বাঙালি নারীরাও পূজায় “Made in Bangladesh” শাড়ি পরে আনন্দ করতে পারছেন।

কলকাতার নারীরা ও বাংলাদেশের শাড়ি
শাড়ি বাঙালি নারীর সর্বজনীন পরিচয়। কলকাতার বাঙালি নারীরাও দুর্গাপূজায় শাড়ি ছাড়া কল্পনা করতে পারেন না। সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতার নারীদের মধ্যে বাংলাদেশের শাড়ির বিশেষ কদর তৈরি হয়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিংবা আড়ং-এর জামদানি কলকাতার বাজারে চাহিদা পেয়েছে। অনেক কলকাতাবাসী নারী পূজার আগে বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে বা আত্মীয়-পরিজনের মাধ্যমে শাড়ি সংগ্রহ করেন। লাল-সাদা তাঁতের শাড়ি কিংবা ঝলমলে সিল্কের শাড়ি কলকাতার পূজা মণ্ডপে বাংলাদেশি পরিচয়েরই বহিঃপ্রকাশ। এভাবে দুই বাংলার সংস্কৃতির বন্ধন শাড়িকে ঘিরেই আরও দৃঢ় হচ্ছে।
নারীর আবেগ ও সাংস্কৃতিক প্রকাশ
পূজার সময় শাড়ি নারীর আবেগের এক বিশেষ বহিঃপ্রকাশ। অঞ্জলি দেওয়ার ভোরে লাল-সাদা শাড়ি, বিকেলের পূজা মণ্ডপে সোনালি-লাল ঝলমলে শাড়ি, আর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রঙিন শাড়ি—এসবই বাঙালি নারীর পূজার অপরিহার্য অংশ। শাড়ি শুধু পোশাক নয়, এটি নারীর পরিচয়, ঐতিহ্য আর আনন্দের প্রতীক।
![]()
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশে পূজার সময় শাড়ির বাজার কয়েকশ কোটি টাকার। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম—সবখানেই শাড়ি বিক্রির ধুম পড়ে যায়। ছোট দোকানদার থেকে বড় ব্র্যান্ড সবাই লাভবান হয়। প্রবাসে রপ্তানি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাও আসে। ফলে পূজার শাড়ি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে।
বিশ্ববাজারে সম্ভাবনা
যেভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বিশ্ববাজারে পরিচিত, পূজার শাড়ির ক্ষেত্রেও সেই সম্ভাবনা রয়েছে। কলকাতা, আসাম, ত্রিপুরা, এমনকি লন্ডন বা নিউইয়র্কের বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশের শাড়ির বাজার দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। অনলাইনে বিক্রি বাড়ছে, নতুন নতুন ডিজাইন জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলে পূজার শাড়ি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হতে পারে।
বাংলাদেশের পূজার শাড়ি এখন ঐতিহ্য, আধুনিকতা, আবেগ এবং অর্থনীতির এক সমন্বয়। বেইলি রোডের জমজমাট বাজার, আড়ং-এর ব্র্যান্ডেড সংগ্রহ এবং কলকাতার নারীদের আগ্রহ—সবকিছু মিলিয়ে “Made in Bangladesh” পূজার শাড়ি আজ দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতীক। একদিকে স্থানীয় তাঁতির শ্রম, অন্যদিকে শহুরে ফ্যাশন ডিজাইনারদের সৃজনশীলতা—সব মিলে পূজার শাড়ি এখন শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও এক উজ্জ্বল পরিচয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















