২০১৮ সালে যখন মেধার ভিত্তিতে চাকরি, কোটা নয়, এই আন্দোলন চলছিল ওই সময়ে একদিন রাত একটারও পরে একটি অজানা নাম্বার থেকে ফোন আসে। পেশার কারণে যত রাত হোক ফোন ধরি। ফোন ধরতেই সে নিজের পরিচয় না-দিয়ে, কথা বলতে শুরু করে। তার কথা কিছুটা এমন ছিল, সব রিপোর্টার আমাদের পক্ষে লিখছেন, আপনি কেন আমাদের বিপক্ষে রিপোর্ট করছেন। এটা আমরা সহজে নেবো না।
পেশার কারণে আমাদের সব কিছু ফেস করার একটা ছোটখাটো অভ্যাস আছে। তাই নরম গলায় বলি, তোমার নাম কী? বলে, আমি নুরুল হক নুরু, আমাকে চেনেন না? আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, দেখ বাবা আমার তো বয়স হয়ে গেছে। তোমাদের ভিসির বয়সও আমার থেকে মনে হয় কম। এজন্য তোমাকে চিনি না। তবে গত কয়েকদিনে তোমার নাম তো জেনেছি।
সে বলে, তবুও আপনি আমাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট লিখছেন। আমি রিপোর্টার ছিলাম ১৯৯৬ অবধি। তবে এখনও রিপোর্ট করি, এবং রিপোর্টার হতে পারলে গর্ব বোধ করতাম। সেভাবে রিপোর্টার হতে পারিনি। তবে নুরু আমাকে যে কারণে রিপোর্টার ও আমার অপিনিয়ন পিস পড়ে সেটাকে রিপোর্ট বলছে- এ কারণ আমাদের কাছে পরিচিত। পেশার তাগিদে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষেত খামার অবধি ঘুরেছি। ওই সব জায়গায় সংবাদপত্রের সব কিছুকে তারা রিপোর্ট মনে করে। এবং সাংবাদিক মানেই রিপোর্টার বা সংবাদদাতা। নিউজ এডিটর, এক্সিকিউটিভ এডিটর, এডিটর এসব তাদের জানার কথা নয়। এ বিষয়ে এম আর আখতার মুকুল ভাই (এ সময়ে তাঁর পরিচয় হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্রের লেখক ও পাঠক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক লিখে দেয়া উচিত, কারণ তাকে বেশি সংখ্যকেরই না চেনারই কথা) এর একটি চমৎকার গল্প আছে- তাঁর বড় ভাই অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারকে নিয়ে। মাস্টার্স করার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে তিনি তাঁর পরিচিত কোনো একটি গ্রামের হাটে গেছেন, হাটের কিছু লোক ওনাদের বাবা বিখ্যাত পুলিশ অফিসার হবার কারণে লেখক সাদাত আলী আখন্দকে চিনতেন- তাই তারা এগিয়ে এসে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারকে বলেন, বাবা তুমি লেখাপড়া শেষ করেছো? উনি বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দেন, হ্যাঁ করেছি। তখন তারা জিজ্ঞেস করে, তা এখন কী করো? তিনি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। তারা বলেন, খালি লেকচার দাও। কোনো কাজকর্ম করো না? মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার বিনয়ের সঙ্গে বলেন, জী। এর বহু বছর পরে উনি আবার কোনো একটা কাজে ওই হাটে গেছেন, তখন ওই লোকদের বয়স বেড়েছে- তারা তাকে দেখে এগিয়ে এসে বলেন, বাবা তুমি কি এখন কিছু করো? মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার বিনয়ের সঙ্গে জবাব দেন, এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার। তারা কিছুটা মুখ বেকিয়ে বলে, খালি পড়ো। কোনো কাজকর্ম করো না? মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার বিনয়ের সঙ্গে বলেন, জী।
তাই এম আর আখতার মুকুল ভাইদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তি-জীবনের অভিজ্ঞতা মেলালে কেউ যদি রিপোর্টার বলে, আর অপিনিয়নকে রিপোর্ট বলে- তাতে আমাদের কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং কষ্ট এটাই যে স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশটি ও যারা দেশ পরিচালনা করছেন, যারা আমরা মিডিয়ার সঙ্গে আছি আমরা এখনও দেশের মানুষের কাছে আলো পৌঁছাতে পারিনি। শুধু তাই নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও অন্ধকার ঢুকে পড়েছে। অন্তত আশির দশক অবধি জেলা শহরের ভালো স্কুলের ছাত্রটিও এ বিষয়গুলো বুঝতো।
যাহোক, নুরু আরো বেশ কিছু শক্ত কথা বলার পরে আমি তাকে ধীরে ধীরে শান্ত করতে সমর্থ হই। বলি দেখ, তুমি আমার সন্তানের মতো। তোমার ভিসি আমাকে দাদা ডাকেন। তুমি আগে আমার লেখাটি পড়ো ভালো করে। দেখ আমি ওখানে জেলা কোটা, নারী কোটা, আদিবাসী কোটা ও ডিসএবল কোটার পক্ষে লিখেছি।
আর কেন জেলা কোটার পক্ষে লিখেছি তা বোঝানোর জন্যে নুরুকে বলি, যতদূর জানি এই জেলা কোটা রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতানুযায়ী। তিনি নিজে যদিও মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তারপরেও শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের কুঁড়েঘরটির মানুষকেও চিনতেন। তিনি জানতেন, দেশের কয়েকটি মাত্র নাম করা স্কুল ছাড়া বাদবাকি স্কুলগুলোতে কী পড়াশোনা হয়। ঠিক তেমনি কয়েকটি কলেজ ছাড়া বাদবাকিগুলোরও একই অবস্থা। তাই জেলা কোটা না রাখলে সাধারণ ঘরের ছেলে মেয়েরা কেউ বিসিএস পাশ করবে না। সবাই ইংরেজি, ম্যাথ এগুলোতে ফেল করবে না হয় অত্যন্ত কম মার্কস পাবে। অর্থাৎ বিসিএসও সেই সিএসপিদের মতো হয়ে যাবে। একটি বিশেষ শ্রেণীর অর্থাৎ আপার-মিডল ক্লাসের সন্তানেরাই শুধু এটা পাবে। এখানে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ছিল, ওরা দরিদ্র ঘরের ছেলে মেয়ে বলে ভালো পড়াশোনার সুযোগ পায়নি। তবে একবার সরকারি চাকরি পেলে বিভিন্ন ট্রেনিং ও বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ নিয়ে ওরা যোগ্য হয়ে উঠবে। এছাড়া আরো কিছু কথা হয় তার সঙ্গে। সন্তানের বয়সী সে। সেগুলো না উল্লেখ করাই উচিত হবে।
ওই বিষয়ে নুরু বা ওর সঙ্গে আরো কয়েকজন যে পাশ থেকে কথা বলছিল তাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ, একটা বিষয় আমার কাছে পরিস্কার নয়, কেন স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। কেন শিক্ষা বিষয়টি সিনিয়রদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পরে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানো হবে সেখানে তাদেরকে অবাধে নকল করতে দিয়ে ৩’শো মার্কের পরীক্ষায় পাস করানো হলো। আর এবার জুলাইয়ের আপরাইজিং এর পরে অটোপাস সহ অনেক কিছুই দেখা গেলো। এমনকি এত কমিশনের বন্যা বয়ে গেলো, ম্যানপাওয়ারের লাইসেন্স অবধি মানুষ দেখতে পেলো অথচ শিক্ষার উন্নয়নে, ছাত্রদের উন্নয়নে কোনো কমিশন মানুষ দেখতে পেল না।
বাস্তবে তরুণদের কেন সবাই অবহেলা করে এর রহস্য সাংবাদিক জীবন দিয়ে উদ্ধার করতে পারেনি। গোয়েন্দা হলে পারতাম কিনা তাও জানি না।
তবে এবারের জেন-জি-দের দেখে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম তারা মেধাবী না হলেও বাস্তববাদী ও বুদ্ধিমান। তাই তারা মেধা ভিত্তিক চাকরির জন্য আন্দোলন করেও কেউ চাকরির দিকে ঝোঁকেনি। তারা রাজনৈতিক দল করেছে।
কারণ কোনো পেশায় নিজস্ব অবস্থান ডেভেলপ করা বাংলাদেশ কেন সব দেশেই অনেক পরিশ্রমের বিষয়। হাজারেও একজন পারে না। সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো চাকরিতে ঢুকলে প্রথম দিকে যে বেতন তাতে যদি চাকরি ক্ষেত্রে ওভারটাইম করার সুযোগ না থাকে তাহলে হয় পার্ট টাইম খুঁজতে হয়- না হয় টিউশন করতে হয় সংসার চালাতে। আর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যখন বিয়ে করতে হয় -তারপরে দেখা যায় সন্তান মানুষ করে পৃথিবী থেকে চলে যাবার বয়স হাতে খুবই কম থাকে। আর অ্যাডভোকেট, ডাক্তার ও সাংবাদিকতার পেশায় সত্যি অর্থে দাঁড়ানো কী কষ্ট তা উল্লেখ না করাই ভালো।
এ হিসেবে বাংলাদেশে খুব সহজে ক্যারিয়ার গড়ার দুটো পথ ছিল একটি রাজনীতি করা অন্যটি এনজিও করা। এনজিও’র বাজারে এখন ভাটা।
কারণ, একদিকে ইউএসএইড বন্ধ অন্যদিকে ইউরোপ এখন একটি দরিদ্র এলাকা। তাই ডোনার নেই। আর ডোনার না থাকায় ক্যারিয়ার গড়া ও পয়সা চুরির দুটো পথই সংকুচিত হয়ে গেছে।
আর এ বিপরীতে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, বেশিক্ষেত্রে একবার এমপি হতে পারলে তার ফোরটিন জেনারেশনে আর কিছু না করলে চলে। আর মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হলে তো কথাই নেই। যেমন ২০০১ সালে একজন শ্রদ্ধেয় উপদেষ্টা (নাম উল্লেখ করা শুধু শিষ্টাচারবহির্ভূত নয়, সাংবাদিকতার এথিকসেরও বাইরে) তিনি ব্যক্তিগত আড্ডায় বলেছিলেন, সরকারে এত টাকা তা সত্যি আগে জানতাম না। পেশাগত জীবনে কোটি টাকার চেক দেখেছি, কিন্তু এখানে তো শত কোটি টাকার নিচে কিছু নেই।
আর বাংলাদেশে ছোট বা বড় একটা রাজনৈতিক দল করতে পারলে তাদের একটি কর্মী বাহিনী থাকে। আর ওই দলের প্রতি যদি সরকারের একটু স্নেহদৃষ্টি থাকে- তাহলে ফুটপাতের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী অবধি তাদের কাছে জিম্মি থাকে। সব মিলে তাদের জিন বা ভূতে অনেক কিছুই জোগান দেয়।
এই বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে যে ছেলে মেয়েগুলো মেধার দাবিতে চাকরি পাবার জন্যে রাজপথে আন্দোলন করলো- তাদের একটি অংশ মেধাবী না হলেও যে বাস্তববাদী সেটা স্বীকার করতেই হবে। কারণ, আমেরিকা, জাপান, চীনের মতো ধনী দেশগুলোতে যেখানে ক্যারিয়ার গড়ে স্ট্যাবলিশড হতে বেশি বয়সে ছেলেরা বিয়ে করছে বলে, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, জাপান টাইমস নিউজ করেছে। এমনকি ওই সব উন্নত দেশের অনেক মেয়েরা পড়াশোনা শেষে নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে বা পছন্দের মানুষটি স্ট্যাবলিশড না হওয়ায় এক পর্যায়ে তারা বিয়ে করতে পারছে না। এমন একটি পৃথিবীতে আমাদের জেন জি যে চাকরির পথে না গিয়ে রাজনৈতিক দল করে, দ্রুত ভালো বিয়ে, ভালো বাড়ি, গাড়ি সবই করতে সমর্থ হয়েছে- এটা মোটেই কম মেধার নয়। বরং এখানে তারা বড় বড় নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদেরকে হারিয়ে দিয়েছে।
আমাদের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এই তরুণরাই দেশ ও জাতিকে পথ দেখাবে। আমরা মাথা পেতে সেই বাক্য মেনে নিয়েছি, যে সব বন্ধু বা ছোটভাইরা মিন মিনে গলায় বলে, সন্তানটিকে দেশ থেকে বের করে দিতে পারলে অন্তত বাঁচতাম, নিজের যাই হয় হোক- ওই সব হতাশ বন্ধু ও ছোটভাইদের থেকে এ মুহূর্তে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.