ইসরায়েলি হামলার নতুন মাত্রা
প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক বজায় রাখা আরব দেশগুলো গাজার যুদ্ধকে রাজনৈতিক সংকট হিসেবেই দেখছিল। তারা যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিল, যদিও অসন্তোষ দানা বাঁধছিল ভেতরে ভেতরে। কিন্তু একই সপ্তাহে কাতারের রাজধানী দোহা ও গাজা শহরে ইসরায়েলের হামলার পর এখন সেই দেশগুলোর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে—তাদের নিজস্ব নিরাপত্তাও কি ঝুঁকির মুখে পড়ছে?
দোহায় হামলার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া
৯ সেপ্টেম্বর হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে দোহায় ইসরায়েলি বিমান হামলা চালানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতার দীর্ঘদিন ধরেই গাজার যুদ্ধ বন্ধে শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এই হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এইচ. এ. হেলিয়ার বলেন, মিসর, জর্ডান ও তুরস্কের এখন উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই—কারণ তাদের দেশেও এমন হামলার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই ঘটনার কয়েক দিন পর ইসরায়েল গাজা শহরে স্থল অভিযানে নামে, যা লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণ গাজায় পালাতে বাধ্য করে। ইসরায়েল জানায়, দোহায় হামলার উদ্দেশ্য ছিল হামাসকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে না দেওয়া এবং গাজায় অভিযানের লক্ষ্য হলো তাদের শেষ ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা।
মিসরের প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
১৯৭৯ সালে প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা মিসর এবার সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। দোহায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক জরুরি সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে “শত্রু” বলেন। মিসরের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রধান দিয়া রাশওয়ান জানান, শান্তি চুক্তির পর থেকে কোনো মিসরীয় প্রেসিডেন্ট এভাবে প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে শত্রু বলেননি।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে দিয়েছে যে, গাজায় অভিযান নতুন এক বিপর্যয়ের পথ খুলে দিচ্ছে। তারা একে আখ্যা দিয়েছে “ইসরায়েলের বেপরোয়া আচরণ ও ঔদ্ধত্য থেকে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার নতুন ধাপ।”
সীমান্ত সংকট ও ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শঙ্কা
গাজার দক্ষিণে সিনাই উপদ্বীপে মিসরের সীমান্ত সরাসরি সংযুক্ত। মিসরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, ইসরায়েলি অভিযানের কারণে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি সীমান্তে এসে ভিড়তে পারে। এ পরিস্থিতি মিসরের জন্য ভয়াবহ সংকট ডেকে আনবে। একদিকে তারা ফিলিস্তিনিদের স্থানচ্যুত করতে ইসরায়েলকে সহযোগিতা করছে বলে অভিযুক্ত হতে চায় না, অন্যদিকে উদ্বিগ্ন যে হামাস যোদ্ধারা শরণার্থীদের সঙ্গে মিশে গেলে ইসরায়েল মিসরের অভ্যন্তরে হামলা চালাতে পারে।
ইতিমধ্যেই মিসর অন্তত এক লাখ গাজার মানুষকে চিকিৎসার জন্য আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দেশটি অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত এবং আরও বিপুলসংখ্যক শরণার্থী নেওয়ার চাপ সামলানো তাদের পক্ষে কঠিন।
সামরিক প্রস্তুতি ও সতর্কবার্তা
ইসরায়েলি গণমাধ্যমে খবর এসেছে, মিসর সিনাই উপদ্বীপে সেনা বাড়াচ্ছে, যা নিয়ে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বেগ জানিয়েছে। যদিও মিসর এ বিষয়ে কিছু নিশ্চিত করেনি। তবে মিসরের পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্য ইয়াহইয়া আল-কাদওয়ানি বলেন, ফিলিস্তিনিদের জোর করে স্থানচ্যুত করা “লাল রেখা” এবং এমন হলে মিসর কঠোর অবস্থান নেবে।
জর্ডানের শঙ্কা
জর্ডানও পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশটি বহু বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি বজায় রাখলেও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের নিয়ে তারা চিন্তিত। প্রায় ত্রিশ লাখ ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীরে বসবাস করে এবং জর্ডানের আশঙ্কা—ইসরায়েল যদি পশ্চিম তীরের বড় অংশ দখল করে, তবে ফিলিস্তিনিদের জোর করে তাদের দেশে ঠেলে দেওয়া হতে পারে।
উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান পরিবর্তন
অনেক উপসাগরীয় দেশ এতদিন ইরানকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে ইসরায়েলের সঙ্গে সীমিত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। কিন্তু দোহায় হামলার পর পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক হেলিয়ার-এর মতে, এখন উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকেই তাদের নিরাপত্তার বড় হুমকি হিসেবে দেখছে।
কাতার আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করলেও আলোচনার টেবিলে তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। দোহায় হামলার পর সেই সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে গেছে।
সৌদি আরবের নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি
কেবল নিন্দাতেই থেমে থাকেনি কিছু দেশ। গত সপ্তাহে সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়েছে, এক দেশের ওপর হামলা মানে উভয়ের বিরুদ্ধে হামলা। বিশ্লেষকদের মতে, এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি উপসাগরীয় দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকেও প্রকাশ করে, কারণ তারা মনে করছে ওয়াশিংটন পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিচ্ছে না।
বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক আন্দ্রেয়াস ক্রিগ সতর্ক করেছেন, এ পরিস্থিতি ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়কার মতো একটি বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করছে। গত কয়েক দশক ধরে বিষয়টি মূলত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মধ্যেই সীমিত ছিল। কিন্তু প্রতিটি নতুন ইসরায়েলি পদক্ষেপ এখন আরব দেশগুলোকে সরাসরি জড়িয়ে ফেলতে পারে।
তিনি লিখেছেন, “গাজা নিয়ে ইতিমধ্যেই ক্ষুব্ধ আরব জনগণ এখন ইসরায়েলকে সম্মিলিতভাবে আরবদের জন্য একটি বাস্তব হুমকি হিসেবে দেখছে।”