০৭:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

পারমাণবিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ কি এবার সফল হবে?

যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ উদ্যোগের মূল ভরসা কয়েকটি স্টার্টআপ কোম্পানি, যারা দাবি করছে তারা প্রায় সব ধরনের তেজস্ক্রিয় বর্জ্যকে নতুন জ্বালানিতে রূপান্তর করতে পারবে। তবে এই প্রযুক্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে।

ওকলো এবং তাদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা

ওকলো নামে একটি কোম্পানি ঘোষণা করেছে, তারা ১.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে টেনেসির একটি পুরনো স্থানে “অ্যাডভান্সড ফুয়েল সেন্টার” তৈরি করবে।এখানেই একসময় ম্যানহাটন প্রজেক্টের জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়েছিল।

পরবর্তী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে সেখানে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরনো রিঅ্যাক্টর বর্জ্যকে নতুন জ্বালানিতে রূপান্তর করার কাজ শুরু হবে।

প্লুটোনিয়াম ব্যবহারের পরিকল্পনা

কেবল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য নয়, ভেঙে ফেলা পারমাণবিক অস্ত্র থেকে উদ্ধার করা প্লুটোনিয়ামও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে জ্বালানি বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এ ধরণের উদ্যোগের ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রে তেমন ভালো নয়। এর আগেও এ ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি এক পর্যায়ে অন্য একটি দেশকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতেও সহায়তা করেছে।

Trump's nuclear 'renaissance' rests on risky plan for radioactive waste -  The Washington Post

প্রযুক্তি নিয়ে সংশয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওকলো কিংবা অন্য স্টার্টআপগুলোর প্রযুক্তি আসলে নতুন নয়। এ ধরনের পদ্ধতি কয়েক দশক আগে পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ব্যর্থ হয়েছে। সামান্য পরিবর্তন করে এখন সেগুলোকে নতুন নামে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সমালোচকদের মতে, নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে।

প্রশাসনের সমর্থন ও রাজনৈতিক দিক

ট্রাম্প প্রশাসন এ পরিকল্পনায় আস্থা রাখছে। প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং আইনগত সব সুযোগ কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণকে এগিয়ে নিতে বলেছেন।

ওকলোর প্রধান নির্বাহী জেকব ডিউইট এ সময় হোয়াইট হাউসে উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, নতুন জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইট পূর্বে ওকলোর বোর্ডে ছিলেন।

পাইরোপ্রসেসিং: পুরনো কিন্তু আলোচিত পদ্ধতি

ওকলো এবং কুরিও নামের আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা মূলত “পাইরোপ্রসেসিং” প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এতে ব্যবহৃত জ্বালানি ছড়ানো লবণে রাখা হয় এবং বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে নতুন জ্বালানি আলাদা করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রযুক্তি তৈরি হয়েছিল, তবে অস্ত্রগ্রেড উপাদান তৈরির ঝুঁকি ও ব্যয়ের কারণে এটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়নি।

Trump's nuclear 'renaissance' rests on risky plan for radioactive waste -  The Boston Globe

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

যুক্তরাজ্য, জাপান ও ফ্রান্স—সবাই এ ধরনের প্রকল্প চালিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও জাপানে ব্যয় ও প্রযুক্তিগত সমস্যায় ব্যর্থতা এসেছে। ফ্রান্স কিছুটা সফল হলেও তাদের ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক সরকারি ভর্তুকি প্রয়োজন।

বিরোধী মত

প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী আর্নেস্ট মনিজ সতর্ক করে বলেছেন, প্লুটোনিয়াম পুনঃব্যবহার নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে, বিদ্যুতের খরচ বাড়াবে এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে সমস্যা তৈরি করবে।

এমনকি ১৭ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও সাবেক কর্মকর্তা কংগ্রেসে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছেন যে, এই পদক্ষেপ পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তির অনিচ্ছাকৃত বিস্তার ঘটাতে পারে।

Trump tightens control of independent agency overseeing nuclear safety - OPB

রাজনৈতিক সমর্থন ও রাজ্যগুলোর আগ্রহ

টেনেসি ও উটাহসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ইতিমধ্যেই এসব প্রকল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছে। উটাহর জ্বালানি দপ্তর এমনকি ঘোষণা দিয়েছে যে প্রযুক্তিগত ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং নিরাপদ।

মূল সমস্যা রয়ে গেছে

পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের পরও কিছু অংশ তীব্র তেজস্ক্রিয় বর্জ্য থেকে যাবে, যা গভীর ভূগর্ভে চাপা দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি জনগণের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হবে না।

ওকলো, কুরিও এবং তাদের মতো স্টার্টআপগুলো দাবি করছে যে তারা পারমাণবিক বর্জ্য সমস্যার সমাধান করতে পারবে। প্রশাসনও এতে ভরসা রাখছে। কিন্তু ইতিহাস, ব্যর্থ প্রকল্প, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং বিপুল ব্যয়ের অভিজ্ঞতা বিশেষজ্ঞদের মনে বড় সংশয় সৃষ্টি করেছে। তাই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—পারমাণবিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ কি এবার সত্যিই সফল হবে?

জনপ্রিয় সংবাদ

পারমাণবিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ কি এবার সফল হবে?

০৫:০৮:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ উদ্যোগের মূল ভরসা কয়েকটি স্টার্টআপ কোম্পানি, যারা দাবি করছে তারা প্রায় সব ধরনের তেজস্ক্রিয় বর্জ্যকে নতুন জ্বালানিতে রূপান্তর করতে পারবে। তবে এই প্রযুক্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে।

ওকলো এবং তাদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা

ওকলো নামে একটি কোম্পানি ঘোষণা করেছে, তারা ১.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে টেনেসির একটি পুরনো স্থানে “অ্যাডভান্সড ফুয়েল সেন্টার” তৈরি করবে।এখানেই একসময় ম্যানহাটন প্রজেক্টের জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়েছিল।

পরবর্তী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে সেখানে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরনো রিঅ্যাক্টর বর্জ্যকে নতুন জ্বালানিতে রূপান্তর করার কাজ শুরু হবে।

প্লুটোনিয়াম ব্যবহারের পরিকল্পনা

কেবল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য নয়, ভেঙে ফেলা পারমাণবিক অস্ত্র থেকে উদ্ধার করা প্লুটোনিয়ামও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে জ্বালানি বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এ ধরণের উদ্যোগের ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রে তেমন ভালো নয়। এর আগেও এ ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি এক পর্যায়ে অন্য একটি দেশকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতেও সহায়তা করেছে।

Trump's nuclear 'renaissance' rests on risky plan for radioactive waste -  The Washington Post

প্রযুক্তি নিয়ে সংশয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওকলো কিংবা অন্য স্টার্টআপগুলোর প্রযুক্তি আসলে নতুন নয়। এ ধরনের পদ্ধতি কয়েক দশক আগে পরীক্ষিত হয়েছিল এবং ব্যর্থ হয়েছে। সামান্য পরিবর্তন করে এখন সেগুলোকে নতুন নামে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সমালোচকদের মতে, নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে।

প্রশাসনের সমর্থন ও রাজনৈতিক দিক

ট্রাম্প প্রশাসন এ পরিকল্পনায় আস্থা রাখছে। প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং আইনগত সব সুযোগ কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণকে এগিয়ে নিতে বলেছেন।

ওকলোর প্রধান নির্বাহী জেকব ডিউইট এ সময় হোয়াইট হাউসে উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, নতুন জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইট পূর্বে ওকলোর বোর্ডে ছিলেন।

পাইরোপ্রসেসিং: পুরনো কিন্তু আলোচিত পদ্ধতি

ওকলো এবং কুরিও নামের আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা মূলত “পাইরোপ্রসেসিং” প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এতে ব্যবহৃত জ্বালানি ছড়ানো লবণে রাখা হয় এবং বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে নতুন জ্বালানি আলাদা করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রযুক্তি তৈরি হয়েছিল, তবে অস্ত্রগ্রেড উপাদান তৈরির ঝুঁকি ও ব্যয়ের কারণে এটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়নি।

Trump's nuclear 'renaissance' rests on risky plan for radioactive waste -  The Boston Globe

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

যুক্তরাজ্য, জাপান ও ফ্রান্স—সবাই এ ধরনের প্রকল্প চালিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও জাপানে ব্যয় ও প্রযুক্তিগত সমস্যায় ব্যর্থতা এসেছে। ফ্রান্স কিছুটা সফল হলেও তাদের ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক সরকারি ভর্তুকি প্রয়োজন।

বিরোধী মত

প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী আর্নেস্ট মনিজ সতর্ক করে বলেছেন, প্লুটোনিয়াম পুনঃব্যবহার নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে, বিদ্যুতের খরচ বাড়াবে এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে সমস্যা তৈরি করবে।

এমনকি ১৭ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও সাবেক কর্মকর্তা কংগ্রেসে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছেন যে, এই পদক্ষেপ পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তির অনিচ্ছাকৃত বিস্তার ঘটাতে পারে।

Trump tightens control of independent agency overseeing nuclear safety - OPB

রাজনৈতিক সমর্থন ও রাজ্যগুলোর আগ্রহ

টেনেসি ও উটাহসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ইতিমধ্যেই এসব প্রকল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছে। উটাহর জ্বালানি দপ্তর এমনকি ঘোষণা দিয়েছে যে প্রযুক্তিগত ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং নিরাপদ।

মূল সমস্যা রয়ে গেছে

পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের পরও কিছু অংশ তীব্র তেজস্ক্রিয় বর্জ্য থেকে যাবে, যা গভীর ভূগর্ভে চাপা দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি জনগণের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হবে না।

ওকলো, কুরিও এবং তাদের মতো স্টার্টআপগুলো দাবি করছে যে তারা পারমাণবিক বর্জ্য সমস্যার সমাধান করতে পারবে। প্রশাসনও এতে ভরসা রাখছে। কিন্তু ইতিহাস, ব্যর্থ প্রকল্প, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং বিপুল ব্যয়ের অভিজ্ঞতা বিশেষজ্ঞদের মনে বড় সংশয় সৃষ্টি করেছে। তাই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—পারমাণবিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ কি এবার সত্যিই সফল হবে?