বাণিজ্য আলোচনা ও মুদ্রার ধাক্কা
দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্য আলোচনা রাজনৈতিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, সিউল হয়তো ক্ষতিকর চুক্তি স্বাক্ষর করবে অথবা একেবারেই চুক্তি ভেস্তে যেতে পারে।
এরই মধ্যে কোরিয়ান মুদ্রা ‘উন’ মার্কিন ডলারের বিপরীতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১,৪০০ মাত্রা ভেঙে নিচে নেমে গেছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এটি আরও অবমূল্যায়নের পথ খুলে দিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ংয়ের সতর্কবার্তা
সোমবার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং বলেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়া ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তবে দেশটির অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় (এফএক্স সুয়াপ) চুক্তি প্রয়োজন হবে।
তার এই মন্তব্য জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের দাবিগুলো মেনে নিলে ১৯৯৭ সালের মতো আরেকটি আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে অথবা পুরো বাণিজ্য চুক্তিই ভেস্তে যেতে পারে।

বিনিয়োগের প্রভাব ও মুদ্রার চাপ
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী সরাসরি অর্থ স্থানান্তর হলে প্রতিবছর প্রায় ১০০ থেকে ১২০ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা তৈরি হবে। এতে ডলার-উন বিনিময় হারের ওপর প্রবল চাপ পড়বে।
KB Securities-এর অনুমান অনুযায়ী, এ ধরনের বিনিয়োগ হলে আগামী তিন বছরে প্রতি বছর উন প্রায় ১০০ পয়েন্ট অবমূল্যায়িত হতে পারে।
এই কারণে প্রেসিডেন্ট লি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সঙ্গে জাপানের মতো মুদ্রা বিনিময় চুক্তি করার দাবি তুলছেন। তবে সিটিগ্রুপ মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত সীমাহীন বিনিময় চুক্তি মেনে নেবে না। এর বদলে তারা FIMA Repo Facility নামের একটি বিকল্প ব্যবস্থা প্রস্তাব করতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সিকিউরিটিজ জামানত রাখা হবে।
বাণিজ্য চুক্তির অচলাবস্থা
সিউল ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বর্তমানে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ তহবিল কীভাবে গঠন করা হবে, তা নিয়ে অচলাবস্থা চলছে। এ তহবিল বৃহত্তর বাণিজ্য চুক্তির অংশ, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে সর্বোচ্চ ১৫% শুল্ক নির্ধারণের কথা ছিল।

যদি সমঝোতা না হয়, তবে দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে শুল্ক বেড়ে ২৫% হতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কোরিয়ান পণ্য জাপান ও ইউরোপীয় পণ্যের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হবে।
অতীত সংকটের ছায়া
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকের বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের স্মৃতি এখনো কোরিয়ার নীতি-নির্ধারকদের মনে গভীরভাবে রয়ে গেছে। সে কারণেই কোরিয়ান উনের বৈদেশিক বাজার এখনো সীমিত। বর্তমানে বৈশ্বিক মুদ্রা লেনদেনে উনের অংশ মাত্র ২%, যেখানে জাপানি ইয়েনের অংশ ১৭%।
রাজনৈতিক দিক থেকেও চাপ রয়েছে। কোরিয়ার ইতিহাসে প্রেসিডেন্টদের অভিশংসনের নজির রয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্ট লির অভিশংসনের ঝুঁকি কম, তবুও তিনি প্রকাশ্যে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চাপের কথা স্বীকার করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতবিরোধ
দক্ষিণ কোরিয়া প্রস্তাব দিয়েছে যে বিনিয়োগের অর্থ সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ ও ঋণ নিশ্চয়তার সমন্বয়ে আসবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র জাপানের মতোই শর্ত চাইছে—যেখানে টোকিওকে কোনো প্রকল্প নির্বাচনের ৪৫ দিনের মধ্যে নগদ অর্থ সরবরাহ করতে হয়।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মন্তব্য করেছেন, প্রেসিডেন্ট লি অভিশংসনের ঝুঁকির কথা প্রকাশ্যে বলছেন যাতে তিনি এই বার্তা দিতে পারেন যে এমন চুক্তি করা সম্ভব নয়।
মুদ্রার ওপর বাড়তি চাপ
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির কারণে বিনিয়োগকারীরা এটিকে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য এক ধরনের ‘হার-জিত’ পরিস্থিতি হিসেবে দেখছেন। ফলে উনের ওপর চাপ ক্রমশ বাড়ছে।
একজন স্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ী বলেছেন, যদি ৩৫০ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে বেরিয়ে যায়, তবে উন সহজেই ১,৪৫০ মাত্রায় নেমে যেতে পারে। তিনি যোগ করেন, অনিশ্চয়তার কারণে এখনই উন অস্থির হয়ে আছে, আর অর্থ স্থানান্তর শুরু হলে পতন নিশ্চিত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















