ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা আসামের বৃদ্ধা সাকিনা বেগমকে হেফাজতে নিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। আদালত তাকে পাঠিয়েছে গাজিপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারে। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
‘ঢাকার মিরপুরে আশ্রয় নেওয়া ভারতের সাকিনা বেগমকে যেভাবে খুঁজে পেল বিবিসি’-
এই শিরোনামে বিবিসি বাংলায় খবর প্রকাশ হয় গতকাল বৃহস্পতিবার। সেদিনই দুপুরে মিরপুরের যে বাসায় সাকিনা বেগম আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখান থেকে তাকে হেফাজতে নেয় ভাষানটেক থানা পুলিশ।
পুলিশ বলছে, বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন সাকিনা বেগম। প্রকাশিত সংবাদ এবং স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়। পরে আইনী প্রক্রিয়া অনুযায়ী তাকে শুক্রবার আদালতে পাঠানো হয়।
“তার বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও বসবাসের অভিযোগে একটা মামলা দায়ের করা হয়েছে,” বলে জানান ভাষানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
এমন পরিস্থিতিতে সাকিনা বেগমের ভারতে পরিবারের কাছে ফেরার প্রক্রিয়া কী হবে, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। কারণ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে এই মামলায় তার সাজা হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
বিবিসি বাংলাকে সাকিনা বেগম জানিয়েছিলেন, যেভাবেই হোক নিজের পরিবারের কাছেই ফিরে যেতে চান তিনি। তবে মামলা হওয়ায় আদালতের হাতেই এখন পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, আইনী প্রক্রিয়ায় নিজেকে ভারতের নাগরিক প্রমাণ এবং সেই বিষয়টি গ্রহণ করে তাকে ফেরাতে ভারতের আগ্রহ- এমন নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে সাকিনা বেগমের ফেরা।
যদিও আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে দুই দেশের কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনার পর সাকিনা বেগমের ফেরার প্রক্রিয়াটি, মোটেই সহজ হবে না বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
‘যাইতে চাইতাছিলো না, বলতেছিল ‘হায় আল্লাহ আমার কি হবে’
মিরপুরের যে বাসায় ভারতের আসামের সাকিনা বেগম আশ্রয় নিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে সেখান থেকে তাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে পুলিশের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে, শুক্রবার দুপুরে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাঠানো হয়।
তাকে আশ্রয় দেওয়া ওই পরিবারটি বলছে, যেতে না চাইলেও পুলিশ সাকিনা বেগমকে নিয়ে গেছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, আইনের মাধ্যমে সাকিনা বেগমকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হবে।
আশ্রয়দাতা ওই পরিবারটির একজন ক্লান্তি আক্তার। তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুর একটার দিকে থানা পুলিশ তাকে নিয়ে গেছে।
“উনি যাইতে চাইতাছিলো না, বলতেছিল ‘হায় আল্লাহ আমার কি হবে’। আমাদেরকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করতেছিল উনি,” বলেন মিজ আক্তার।
শুক্রবার ওই বৃদ্ধার সঙ্গে থানায় গিয়ে দেখা করার কথাও জানান তিনি। বলেন, “থানায় গেছিলাম ওনার (সাকিনা বেগম) সঙ্গে দেখা করতে। একজন পুলিশ আমাদেরকে বলছেন, ওনারে নিয়ে কোর্টে যাচ্ছি, এরপর আর তার সঙ্গে কথা হয় নাই।”
মিজ আক্তার বলছেন, “যেভাবেই হোক উনি যেন নিজের দেশে পরিবারের কাছে ফিরে যাইতে পারেন।”
এদিকে, অবৈধভাবে একজন নারী মিরপুরের ওই এলাকায় বসবাস করছেন এই খবর পেয়েই তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ভাষানটেক থানার পুলিশ। ৬৫ বছর বয়সী সাকিনা বেগমকে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানোর কথাও বলছে পুলিশ।
ভাষানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ ফয়সাল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে জানান, “যেহেতু তিনি ভারতীয় নাগরিক এদেশে আসছেন, তার কোন প্রকৃত ডকুমেন্টস নাই, সেজন্য তাকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে আদালতে প্রেরণ করেছি।”
তিনি জানান, দ্যা কন্ট্রোল এন্ট্রি অ্যাক্ট- ১৯৫২ এর অধীনে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে সাকিনা বেগমের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে। এখন তার বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন আদালত।
সাধারণত একদেশের নাগরিককে অন্য দেশে যেতে বা সেখানে বসবাস করতে হলে পাসপোর্ট, ভিসাসহ নানা ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যেতে হয়। অন্যথায় অবৈধ অনুপ্রশের দায়ে আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার শঙ্কা থাকে।
তার ফেরার প্রক্রিয়া কী জটিল হলো?
সাকিনা বেগমের ভারতীয় নাগরিক হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে বিবিসি বাংলার অনুসন্ধানে। যেখানে আসামের নলবাড়ি জেলার বরকুরা গ্রামে থাকা তার পরিবারের সদস্যরাও সাকিনা বেগমকে ভিডিও কলে শনাক্ত করেছেন।
পুলিশের গ্রেফতার ও মামলার পর এখন আদালতের মাধ্যমে আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সাকিনা বেগমকে ফিরতে হবে তার পরিবারের কাছে। তবে, এই প্রক্রিয়ায় তিনি শাস্তির মুখেও পড়তে পারেন।
আইনী প্রক্রিয়া অনুযায়ী, বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বাংলাদেশে প্রবেশ এবং অবৈধভাবে এদেশে বসবাস দুটিই অপরাধ।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর, দ্যা কন্ট্রোল অব এন্ট্রি অ্যাক্ট- ১৯৫২ এর অধীনে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তার বিরুদ্ধে যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে, সেটিতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে সাকিনা বেগমকে।
বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপও নিতে পারে আদালত। এছাড়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ওপরও তার ফেরার বিষয়টি নির্ভর করছে।
এক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতির কথা বলছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজীল মোরশেদ। তিনি বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। যার অধীনে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে এই বৃদ্ধাকে তার পরিবারের কাছে পাঠানো যেতে পারে।
অথবা, অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা থেকে মুক্তির পর বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় দূতাবাস যদি এই নারীকে ট্রাভেল পাস দেয় তাহলে তিনি ফিরতে পারেন।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালতে তার ভারতীয় নাগরিক হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা, নাগরিক হিসেবে ভারত তাকে গ্রহণ করে কিনা, এমন নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে।
তবে, “যে আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাকে যেতে হোক না কেন, বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের সম্পর্ক বিবেচনায় এই নারীর দেশে ফেরার বিষয়টি এখন খুবই জটিল হয়ে গেলো,” বলেই মনে করেন মি. মোরশেদ।
তার মতে, আসলেই ভারতীয় নাগরিক হয়ে থাকলে, যখন সাকিনা বেগমকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছিল তখনই যদি সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তাকে পুশ-ব্যাক করতো, তাহলেই বরং বিষয়টি সহজ হতো।
মি. মোরশেদ বলছেন, “এই মামলায় তার জামিন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে, গ্রেফতার ও মামলা থাকায় এখন তাকে, অ্যাম্বাসির মাধ্যমে নিয়ে চলে যাবে এটা অতটা সহজ ব্যাপার নয়।”
পুরো বিষয়টি অবশ্য মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী। তবে, “সেখানে আইন এবং মানবিক দৃষ্টি মুখোমুখি অবস্থায় পড়বে,” বলেন তিনি।
BBC News বাংলা