মার্কিন সিদ্ধান্ত ও প্রাথমিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, আগামী ১ অক্টোবর ২০২৫ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা সব ব্র্যান্ডেড ও পেটেন্টকৃত ওষুধের ওপর ১০০% শুল্ক আরোপ করা হবে। তবে ভারত আপাতত বড় কোনো ক্ষতির মুখে পড়ছে না, কারণ ভারতের অধিকাংশ ওষুধ রপ্তানি মূলত জেনেরিক ওষুধ, যা এই শুল্কের বাইরে থাকছে।
ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন, কোনো কোম্পানি যদি যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ উৎপাদনের কারখানা গড়ে তোলে বা নির্মাণ করে, তাহলে তাদের ওষুধের ওপর শুল্ক আরোপ করা হবে না। এছাড়া যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশও এ শুল্কের বাইরে থাকবে বলে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে।
ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের প্রতিক্রিয়া
শুল্ক প্রত্যক্ষভাবে ভারতের রপ্তানিকে খুব বেশি না ছুঁলেও শুক্রবার ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল শেয়ারের দাম তীব্রভাবে কমে যায়। বিনিয়োগকারীরা একদিকে ছাড় পাওয়ায় স্বস্তি পেলেও, ভবিষ্যতের নীতিগত অনিশ্চয়তা তাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
ওকহার্টের শেয়ার ৯.৪০% কমে যায়, লরুস ল্যাবস প্রায় ৬%, ইন্ডোকো রেমেডিজ ৫.৩৫% এবং জাইডাস লাইফসায়েন্সেস ৪.২১% হ্রাস পায়। ভারতের সবচেয়ে বড় ওষুধ কোম্পানি সান ফার্মা প্রায় ৩% হারায়। ক্যান্সারের জন্য জটিল বায়োসিমিলার উৎপাদনকারী বায়োকন-ও ৪.৬% কমে যায়।
বাজার ও বিশেষজ্ঞ মত
বিএসই হেলথকেয়ার সূচক ২.১৪% কমে দাঁড়ায় ৪৩,০৪৬.৬৯ পয়েন্টে, আর সেনসেক্স প্রায় ১% নিচে নেমে যায়।
রিলিগেয়ার ব্রোকিংয়ের গবেষণা বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অজিত মিশ্র বলেন, “ঘোষণার কারণে বাজারে ধাক্কা লেগেছে, তবে আপাতত শুল্ক কেবল ব্র্যান্ডেড ওষুধের ওপর। ভারতের অধিকাংশ রপ্তানি জেনেরিক ওষুধ, যা এখনো শুল্কমুক্ত। তবে ভবিষ্যতের নীতিগত দিক অনিশ্চিত রয়ে গেছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সান ফার্মার মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর খুব বড় প্রভাব পড়বে না। সিস্টেমাটিক্স গ্রুপের বিশ্লেষক বিশাল মঞ্চন্দা বলেছেন, এর প্রভাব সান ফার্মার ইবিটিডিএ-র মাত্র ১% থেকে ৩% পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।
জেনেরিক বনাম ব্র্যান্ডেড ওষুধ
ভারতের রপ্তানি বাজারে জেনেরিক ওষুধই সবচেয়ে বড় অংশ, যেগুলো মূলত পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তৈরি হয় এবং সস্তায় বিক্রি হয়। এ কারণেই ভারতকে বলা হয় “বিশ্বের ফার্মেসি।” বর্তমানে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদক দেশ এবং বৈশ্বিক জেনেরিক রপ্তানির ২০% সরবরাহ করে।
অন্যদিকে, ব্র্যান্ডেড বা পেটেন্টকৃত ওষুধ হলো আসল আবিষ্কারভিত্তিক ফর্মুলা, যা আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো তৈরি করে এবং উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। এ ধরনের ওষুধের ওপরই ট্রাম্পের ১০০% শুল্ক আরোপ হবে। এছাড়া বায়োসিমিলার, যা জটিল বায়োলজিকাল ওষুধের সস্তা বিকল্প—এই শুল্কের আওতায় আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা ও শুল্ক রাজনীতি
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চীন ও ভারতের ওপর ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। সেন্টার ফর আ প্রসপারাস আমেরিকার তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা মোট জেনেরিক ওষুধ ও প্রয়োজনীয় উপাদানের ৭০% থেকে ৮০% আসে চীন ও ভারত থেকে। ২০২৩ সালে ভারতীয় একটি কারখানা এফডিএ নিরাপত্তা নিয়ম ভঙ্গ করায় বন্ধ হয়ে গেলে আমেরিকায় ক্যান্সারের ওষুধের ঘাটতি দেখা দেয়।
এ ধরনের সংকটই ট্রাম্প প্রশাসনকে আমেরিকার ভেতরে উৎপাদন বাড়াতে চাপ দিচ্ছে। এর আগে জুলাই মাসে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর না করলে ২০০% শুল্ক বসানো হবে। বর্তমান সিদ্ধান্তকে সেই ধারাবাহিক চাপেরই অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ফার্মাসিউটিক্যাল সহযোগিতা এখন ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের বিনিয়োগ বাড়াতে ওয়াশিংটন আগ্রহী। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর-এর বৈঠকেও এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল খাত ইতোমধ্যে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ অর্থবছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির অংশ ৩৪.৫%। তাই ট্রাম্পের শুল্ক নীতি আপাতত সীমিত প্রভাব ফেললেও ভবিষ্যতের জন্য অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে।