০১:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
ঢাকা বাজারে সূচক বৃদ্ধি, চট্টগ্রামে পতন দুর্নীতিমুক্ত ও প্রযুক্তিনির্ভর ভূমিসেবা নিশ্চিত করাই সরকারের অগ্রাধিকার – সালেহ আহমেদ মিরপুর অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৬ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর ৫০ লাখ টাকা খরচ, কিন্তু কালভার্ট নেই—চাঁদপুরে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ আরমানিটোলায় জুবায়ের হত্যা: এক কলেজছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের ঝুলন্ত মরদেহ : সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগের তীর আলতাফ শাহনেওয়াজের দিকে বরিশালের হিজলায় ইলিশ অভিযানে হামলা—মৎস্য কর্মকর্তাসহ ১৫ জন আহত হংকংয়ে রানওয়ে থেকে সমুদ্রে ছিটকে পড়লো কার্গো বিমান সোনার দামে নতুন রেকর্ড — ভরি প্রতি মূল্য ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকায় পৌঁছাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা: ঋণ মওকুফের আগে গ্রাহককে অবহিত করতে হবে

গাজার এক ডায়েরিঃ কেউ কি বলার আমার কাহিনী

  • Sarakhon Report
  • ০৮:২০:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • 29

রাফাহর এক বাড়ির সামনে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর এক ফিলিস্তিনি বাবা ও তাঁর ছেলেরাএমন ছবির অন্তরাল থেকেই এই লেখা। কে বলবে আমার কাহিনি: গাজার এক ডায়েরি’ বই থেকে নেওয়া একটি অংশত্রিশোর্ধ্ব এক গাজাবাসীর লেখাযিনি ঘরছাড়া হয়ে নির্বাসনে বাস করছেন। দরজাহীন এক চাবিরুটিহীন এক বেকারিস্মৃতিতে পরিণত এক নগর। মিশরে আশ্রয় নেওয়া এই মানুষটি উচ্ছেদপরিচয় ও বেঁচে থাকার এক অনাড়ম্বর দিনলিপি তুলে ধরেছেন। হারিয়ে যাওয়া নিত্যজীবনের প্রতিধ্বনিতাজা ফালাফেলের গন্ধসাগরতীরের ক্যাফের গুঞ্জনশিশুদের খেলাধুলার শব্দএর ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের সাক্ষ্য দিতে ডাকছেন গাজার ধ্বংসস্তূপেরআর সেইসব মানুষের স্থৈর্যেরযারা আজও বুকের ভেতর গল্পগুলো বহন করে চলেছেন।

আমি কোনোদিন ফেরার চাবির ধারণাটা বুঝিনিসেই মরচেধরা তামার চাবি। ১৯৪৮ সালে যারা ঘরছাড়া হয়েছিলেনতাঁদের কাছ থেকে সে চাবি গেছে তাঁদের সন্তানদের হাতেসেখান থেকে নাতিনাতনিদের হাতেএভাবেই প্রজন্মান্তরে। কয়েক বছর আগে মারা যাওয়া আমার এক বন্ধুর নানিযিনি নাজারেথে (আরবিতে আল নাসরা) জন্মেছিলেনবড় হয়েছেনসংসার পেতেছিলেনজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশে শায়িত হওয়ারশেষবার নিজের বাড়ি দেখার আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখেছিলেন। স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি। শেষ বয়সে তাঁর চলাফেরা ছিল কষ্টসাধ্যতবু নাতিনাতনিদের জন্য রান্না করার প্রাণপাত চেষ্টা করতেনতখনও তারা ত্রিশ পেরিয়েছে। আমি যেতামতিনি চেয়ারে বসে থাকতেনআর অন্তরের গভীরে খোদাই হয়ে থাকা জায়গাগুলোর গল্প শোনাতেন। তাঁর চোখে ঝিলিক দেখতামনিজের রান্নাঘরপিকনিকহারিয়ে আসা সেইসব জায়গার কথা বলতে বলতে।

আমারও সেই অনুভূতি বুঝতে সময় লেগেছেপঁয়ত্রিশ বছরেরও বেশি। যখন আমাকেই ঘর ছাড়তে হলোআমার বাড়িআমার রাস্তাআমার শহরআমার দেশ। গাজার দক্ষিণে অসহনীয়যন্ত্রণাময় কয়েক মাসের উদ্বাস্তুজীবন শেষে আমি মিশরে পৌঁছালাম। শরীরটা এসেছেকিন্তু মন-প্রাণ পড়ে রয়েছে ওখানে। ভাড়া বাসায় প্রতি রাতেই আলমারিতে হাত বাড়াইকাপড়-চাদরের ফাঁকে লুকানো পেন্সিলবক্সটা বার করিখুলে দেখি আমার বাড়ির চাবি। জানিতার আর কোনো কাজ নেইভয়াবহ বোমায় দরজাগুলো চূর্ণ হয়ে গেছে। তবু প্রতিবার চাবিটা দেখলেই মনে করাইআশা আছে। কোনো একদিন আমি ফিরবআমার ফ্ল্যাটেআমার রাস্তায়আমার আপনজনদের কাছেআমার গাজায়।

আমি ছোটবেলা থেকেই জানার আগ্রহী ছিলাম। যত জেনেছিততই কখনো না জানলেই বোধহয় ভালো হতোএমন মনে হয়েছে। এই বছর আমাকে শিখিয়েছে—‘পরিচয়’ বলতে কেবল গুণবিশ্বাসআচরণ আর চেহারার সমষ্টি বোঝায় না। আমার ফ্ল্যাটের সেই চাবিটাই এখন আমার পরিচয়ের অংশ। গাজায় প্রতিদিন যেসব পথ ধরে কাজে যেতামবন্ধুর কাছে যেতামসেসব পথও আমার সত্তার অংশ হয়ে গেছে। গন্ধগুলোদৃশ্যগুলোশব্দগুলোসবই আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গাজা সিটিতে আল নাসের আর ওয়াহদা সড়কের মোড়ে গেলে পরিবারের বেকারির রুটি-তন্দুরির সুগন্ধে থমকে দাঁড়াতে হতো। ১৯৮৪ সালেচল্লিশ বছর আগেছোট্ট দোকান হিসেবে শুরুমালিক তাঁর সন্তানদের সঙ্গে রুটি বানাতেননিজস্ব গাড়িতে সরবরাহ করতেন। পরে বড় হলোক্রোসাঁমিষ্টিকুকিসব যোগ হলো।

ডায়েট চলার সময় সেই দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়া ছিল নিদারুণ যন্ত্রণা। বন্ধুরা ওই দোকানটিকেই আড্ডার জায়গা বানিয়েছিলামকোথাও যাওয়ার আগে খাবার দিয়ে শুরুপৃথিবীর সেরা শুরু! এক বন্ধু তাদের ডোনাটে প্রেমে পড়লআমার প্রিয় ছিল সিম্পল পাউরুটি। সামান্য জাতার আর অলিভ তেলব্যসপৃথিবীর সেরা স্যান্ডউইচ। পরে শুনলামউৎপাদন লাইন আর সোলার প্যানেলসব বোমায় গুঁড়ো হয়ে গেছে। বেকারি বন্ধ। তাদের ফেসবুক পেজে শেষ পোস্ট ৬ অক্টোবর ২০২৩গ্রাহকদের প্রতি শুভ শুক্রবারের প্রার্থনা।

বেকারির পাশেই আবু তলাল ফালাফেলছোট দোকানবড় ইতিহাস। তাজা গরম ফালাফেলের জন্য লম্বা লাইন। আমার মতে সেরা ফালাফেল আবু তলালযদিও গাজাবাসীর চিরন্তন বিতর্কআবু তলালনাকি আল সউসিআল রিমাল সড়কে ১৯৭৫ সালে শুরু হয়েছিল আল সউসিবছরের পর বছর ডাউনটাউন গাজা’ হয়ে ওঠা সেই এলাকাতেই। সেই ছোট্ট দোকানই থেকে গেছেশত শত মানুষ সকালের নাশতা বা দিনের শেষে স্যান্ডউইচ নিতে লাইনে দাঁড়াত।

যুদ্ধের মাঝেও শুনলামআল সউসি দক্ষিণে ছোট্ট এক মোড়ে আবার ফালাফেল বিক্রি শুরু করেছেফাটা কাগজে নাম লেখা টাঙিয়ে। আমি গেলামযাদের হাতে টাকা আছেযারা কিনতে পারছেতাদের মুখে একরকম আনন্দ দেখলাম। দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও আমি কিনলাম নাঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে ভেবে নয়কাঠের চুলায় ধীরে তেল গরম হচ্ছে বলে নয়বরং জায়গাটা আর আগের জায়গা নয়মানুষগুলোও নয়গন্ধ নয়অনুভবও নয়।

আমি সৌভাগ্যবানগাজা ছাড়তে পেরেছিমিশরে আসতে পেরেছি। আজও বুঝি নাকেন আমার জীবনটা ওখানে আটকে থাকা শিশু-মহিলা-পুরুষদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হলো। আমার পাওনাছাড়ারবাঁচারবেঁচে থাকার। কিন্তু আমি কি সত্যিই বেঁচে আছিমিশর সুন্দরকিন্তু গাজাবাসীর ভেতর ক্ষতত্রাসঅনিশ্চয়তা। লক্ষ মানুষের ভিড়েমিশরীয় বা অন্য দেশেরআমি সহজেই একজন গাজাবাসীকে চিনে ফেলি। চেহারা বা উচ্চারণে নয়আত্মার গায়ে খোদাই হওয়া যন্ত্রণায়। যেন আমাদের শক্তিগুলো একে অন্যকে টেনে নেয়। সেই বিমর্ষবিহ্বলশোকাভিভূত দৃষ্টিভুল হয় না কখনো। আরেকজন গাজাবাসীসব হারিয়ে মাথা তুলে থাকার চেষ্টাবাঁচার চেষ্টাআদৌ পারবে কি নাজানা নেই।

আমি খুব কম বেরোই। পারি না। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা এক পৃথিবীতে নিজেকে ভাবতেই পারি নাকর্মস্থলে যাওয়া মানুষবই হাতে শিশুচারদিকে খাবার। হে ঈশ্বর! সর্বত্র খাবার! এই পৃথিবীতে সবার জন্য যথেষ্ট খাবার আছেতবু গাজাবাসীরা অনাহারে।

মিশরে এসে প্রথম দিকে পাগলের মতো খাবার অর্ডার করতামক্ষুধা না থাকলেও খেতাম। তারপর উল্টোটাখাওয়া বন্ধ। আমার এক বান্ধবী মা-কে নিয়ে মিশরে এসেছেনগাজায় রয়ে গেছে পরিবার-পরিজন। বললেনভীষণ অপরাধবোধ হয়ওরা যা খায়সেও তাই খায়। গাজায় যদি একটা বীনসের ক্যান জোটেসে-ও মিশরে বীনসের ক্যান কিনে খায়যদি আধখানা রুটি ভাগ পড়েসেও আধখানা রুটি খায়। ওরা না খেলেআমি খাই কীভাবেআমি মায়ের জন্য রান্না করিতিনি অসুস্থকিন্তু হাত দিই না। ওরা খেলেআমি খাই। না খেলেআমিও না।

আরেক বন্ধু আমাকে কয়েক বছর আগের এক ছবির কথা মনে করিয়ে দিলতার কাছে আমার পাঠানোকুনাফার তিন থালা। শীতে আমি তিন থালা কুনাফা খেয়ে দিতামচিনি-উল্লাসে। সে বললসাকাল্লাহ বা আবু আল সাউদগাজার বিখ্যাত মিষ্টির দোকানওখানে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমি তাকে কাজেম আইসক্রিমের লেবু স্লাশের ছবি পাঠালাম। বললামএকদিন আবার একসঙ্গে মিষ্টি খাবো।

যে সমাবেশটা মোটেই মিস করি নাবিদায়-আসর। মিশরে এসে যারা কোনো না কোনোভাবে ভিসা জোগাড় করতে পেরেছেতাদের বেশিরভাগই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিছুই তো আর বাকি নেই। আমি চাইলে হয়তো থাকতামকিন্তু আমি চাই না আমার সন্তানরা আমাদের মতো দুঃস্বপ্ন দেখুক। আমরা চেষ্টা করেছিতুমি জানো। তুমি তো আমার দেখা সবচেয়ে ইতিবাচক মানুষ। দেখো তোমাকেতোমার প্রাণশক্তি হারিয়ে গেছেবাঁচার ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। আমি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার ঝুঁকি নিতে পারি না। তাদের জীবন চিরদিনের জন্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছেআর না।’—দশ ও আট বছরের দুই সন্তানের মা-বন্ধুর কথাগুলো। তিনি বাচ্চাদের নিয়ে গাজা থেকে মিশরকিন্তু স্বামী পারেননি। মিশরে থাকার সময়ই স্বামী তাঁর বাবাকে হারানকবর দিতে পারেননি। যুদ্ধের শুরুতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পান। মাসের পর মাস দোদুল্যমান থাকার পর কঠিন সিদ্ধান্তদুই সন্তানকে নিয়ে চলে গেলেনপেছন ফিরে না তাকিয়েই।

প্রতিটি বিদায়ের শেষে আমি বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতামকাঁদতামআর বারবার বলতাম—‘যুদ্ধটা ধিকযে আমাদের ছেড়ে দিয়েছে আলাদা করে।’ শেষ বিদায়টা ছিল এক বন্ধুর ভাড়া বাসায়। সে স্পেনে চলে গেছেস্ত্রী আর কন্যার জন্য ভালো জীবন খুঁজতে। সবাই চলে গেলে আমি থেকে গেলাম। আমরা কথা বললামএই পৃথিবী কত নির্মমকেমন করে দূর থেকে আমাদের যন্ত্রণা দেখেও কিছুই করে না। বাবার দুইটা স্বপ্ন ছিলএকটা বাড়ি বানাবেনআর ছয় সন্তানকে তাদের পরিবারসহ কাছাকাছি দেখবেনবার্ধক্যে তাঁদের হাসিখুশি মুখ দেখবেন।’—সে বলল। বাবা স্কুলে পড়াতেনপ্রাইভেট টিউশন করতেনঅমানুষিক পরিশ্রমসন্তানদের ভালো জীবন দিতে। ক্লাসের ফাঁকে বাবা কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে পিঠের অসহনীয় ব্যথার ওষুধ খেতেনআমার বুক ফেটে যেত।’ আজ তাদের বাড়ি নেইভাইবোনেরা সারা বিশ্বে ছিটকে। তার মনে হয়ওরা বুদ্ধিমান ছিলআগেভাগে বুঝেছিল গাজা গাজাবাসীদের জন্য নয়। সে থাকতে চেয়েছিলথাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলশেষ পর্যন্ত বুঝলএখানেও থাকা যায় না। বাড়ি নেইবাবা-মা আর ভাইবোন কেউ একসঙ্গে নেই। বাবার স্বপ্ন শেষ।

আমি নিশ্চিত নই—‘বেঁচে গেছি’ বলা ঠিক কি না। আমি বাঁচিনি। শরীরকিছুটাগাজা থেকে বেরিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় আমি ভালো আছিস্বাভাবিক আছিআগের মানুষটা আছি (তারপরওএই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত যুদ্ধ চলছেই)। আতঙ্ক-আক্রমণ এখন গাজাবাসীর নিত্যসঙ্গী। একবার খুব ব্যস্ত সড়কের ধারেই আতঙ্কে আমার পা ভেঙে পড়লদুপাশ দিয়ে হাজার গাড়ি ছুটছেআমি ফুটপাথে লুটিয়ে কেঁদেছিলাম আধঘণ্টা।

ভয়ানক হলোঘুমের ভেতরেও আতঙ্ক-আক্রমণ হয়। একদিন চোখ মেলা মাত্র মনে পড়ল কী হয়েছে আমাদেরকত বাধা সামনেভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছেঅসহ্য এক ঝাঁপটায়।

আমরা কি কোনোদিন গাজায় ফিরবসব হারিয়ে?
আমরা কি সারাজীবন মিশরেই পড়ে থাকবগাজা তো পাশেই?
আমাদের কি তৃতীয় দেশে ঠেলে দেওয়া হবে?
শূন্য থেকে শুরু করতে হবে?
ধীরে ধীরে জীবনভর সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছেটাকা শেষ হলে কী হবে?
জানিআমার কিছু বন্ধু পরিবারসহ মারা গেছেহে ঈশ্বরতারা সত্যিই নেই। আর কখনো দেখব না। আমি নিজেকে প্রতারিত করিভাবিযুদ্ধ থামলেথামলে যদিদেখা হবে। কিন্তু তারা তো মৃত। আমি কি কোনোদিন বাবা-মায়ের কবর দেখতে পারবকবরগুলো কি অক্ষত আছেবোমায় উড়ে গেছে কি?

বিছানা থেকে উঠে আতঙ্কে কাঁপছিলাম। এক বন্ধুকে ফোন করলামসে বললআবার আতঙ্ক-আক্রমণ হচ্ছে। আমরা কথা বললাম এক ঘণ্টা। সত্যি বলতেআমিই কথা বললামসে থেরাপিস্টের মতো শান্ত রাখল।

সামান্য জিনিসও ট্রিগার হয়। এক বন্ধু দীর্ঘদিন পর ছুটি জুটিয়ে দুই দেশ ঘুরে আমার কাছে এলোহাতে কয়েকটা উপহার। পৌঁছে সে চমকে দিতে চাইলতার এক বন্ধুকে দিয়ে আমাকে নিচে ডাকাল। নেমে দেখিদুটো গাছএকটা বড়একটা ছোট। আমরা জড়িয়ে ধরলামকথা বললামকিন্তু আমার মাথা গাছেই আটকেআমি কি ওদের দেখভাল করতে পারবএক বছরের বেশি সময় ধরে নিজের দেখভাল করাই দুঃসাধ্যবেঁচে থাকা কঠিন। কিছুদিন তো বিছানা ছাড়াই সম্ভব নয়খাওয়া-দাওয়াএখন কি আরেকটা জীবন্ত জিনিসের দায়পরদিন ঘুম থেকে উঠেই ছুটে বারান্দায় গেলামগাছ দুটো কেমন আছে। পানি দেওয়াবড় বোঝা। যদি ভুলে যাইএই ভাবনাই দুশ্চিন্তা।

বন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে চেপে এক ঘণ্টার দূরত্বের এক রেস্তোরাঁয় যাচ্ছিলামসে নিশ্চিত ছিলজায়গাটা আমার ভালো লাগবে। হঠাৎ আমি কেঁদে ফেললামসেও কাঁদল। মিনতি করলকী হয়েছে বলি। চেনা মানুষ মারা যায়বারবার। প্রতিদিন নতুন স্বপ্ন নিভে যায়। আমার প্রাণ শুকিয়ে গেছে। আমরা শেষ। আর পারছি না। আমি ভীষণ ক্লান্তঅসহায়দুর্বল।’ আমি বললামআমি আর বাঁচি নাশরীর চলছেভেতরটা মৃত। বাইরে যেতে চাই নানতুন মানুষ চিনতে চাই নাখাচ্ছি নারেস্তোরাঁয়ও যেতে চাই না। সে চালককে থামাতে বলল। আমরা নেমে নাইলের পাড়ে মাটিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললাম।

নাইল সুন্দরতবু আমার মনে পড়ে গাজার সাগর। মাহমুদ দারবিশ একটি কবিতায় লিখেছিলেন
গাজা সবচেয়ে সুন্দর শহর নয়।
এর তীর আরব শহরগুলোর তীরের চেয়ে নীলতর নয়।
এর কমলালেবু ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে সুন্দর নয়।
গাজা সবচেয়ে ধনী শহর নয়।
তার তীর নিঃসন্দেহে সবচেয়ে নীল নয়কিন্তু ওটাই আমার তীর। সমুদ্রতটের বালু জানেবন্ধুদের সঙ্গে কত হাঁটাহাঁটিকত গভীর আলাপহাসি-কান্না মেশানো। সাগরের ধারে একটা ক্যাফে ছিলমাঝে মাঝে আমরা জমতাম। দুপুর আনতামখেলা খেলতামছবি তুলতাম। একবার রমজানে ঠিক করলামসেই ক্যাফেতেই ইফতার। খাবার অর্ডার দিলামমাগরিবের এক ঘণ্টা আগে সবাই জড়ো। কিন্তু খাবার এল দেরিতেআর অর্ডারের অর্ধেক নেই। মনে আছেখ্রিস্টান বন্ধুরা গাড়ি নিয়ে ছুটলখালি হাতে ফিরবে না কথা দিয়ে। আমরা উপোসতবু যাদের খাবার এসে গেছেকেউ মুখে দিচ্ছি নাযতক্ষণ না সবাই পায়। চল্লিশ মিনিট পর তারা ফিরে এলবিজয়ীর হাসিহাতে উঁচু করে দেখাল খাবার। আমরা তাদের নায়কের মতো অভিনন্দন জানালাম!

হ্যাঁগাজা সবচেয়ে সুন্দর শহর নয়তবু এ শহরেই অনেকে প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছেশিশুদের ঘুড়ি উড়েছেমানুষ ব্যবসা শুরু করেছেসাফল্য দেখেছে। গাজার বুকে অসংখ্য স্তরে চাপা পড়ে আছে লক্ষ-লক্ষ গল্পসবাই বলার যোগ্য।

আমি যে গাজাকে চিনিসেখানে মসজিদ আর গির্জা পাশাপাশি। গাজার প্রাচীনতম সেন্ট পারফিরিয়ুস গির্জাএক দেয়াল ভাগ করে আছে মসজিদের সঙ্গে। বড় ক্রুশটা মসজিদের মিনারের সমান্তরালে। আমি যে গাজাকে চিনিসেখানে বহু মুসলমান বড়দিনে ওয়াইএমসিএ-তে গাছ আলোর উৎসব দেখে আনন্দ করে। আমি যে গাজাকে চিনিসেখানে খ্রিস্টানরা পুরো রমজানজুড়ে উপবাস করেছে মুসলিম বন্ধুদের সংহতিতেএকসঙ্গে ইফতার করেছে। যুদ্ধের ভয়াল দিনে গির্জা আশ্রয় দিয়েছেখ্রিস্টান-মুসলমান নির্বিশেষেবাড়িছাড়া মানুষদের। দুর্ভাগ্যসেন্ট পারফিরিয়ুস গির্জা বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেগাজার প্রাচীনতম আল উমারি মসজিদপঞ্চম শতকে নির্মিতসেটিও ধ্বংস হয়েছে।

বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সে বললতার বাড়ির ক্রিসমাস ট্রিটাকে বড্ড মিস করে। আমিও বললামআমার ট্রির কথা। আমরা দুজনেই মুসলমানতবু ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিট্রি ছিল ঘরের প্রাণ। দুদিন পর গুগল ফটোস আমাকে পুরোনো একটা সেলফি দেখালট্রির পাশে দাঁড়িয়ে। আমি পাঠালাম ওকে।

গুগল ফটোস একরকম ইতিহাসের খাতা। আমার এক বন্ধু আগে বিরক্ত হতোআমি এত ছবি তুলি বলে। এখনআমাদের বন্ধুমহল ছিটকে পড়েছেকেউ গাজায় আটককেউ মিশরেবাকিরা নানা দেশেসে কৃতজ্ঞ—‘তুমিই তো এই ছবিগুলো পাঠিয়েছিলেএগুলো আমাদের ভালো দিনের স্মারক। কখনো ভাবিনিএকসঙ্গে বসার সুযোগই আর হবে না।

একজন পরিচিতযিনি গাজাতেই আছেনবললেনআজ যদি সড়ক দিয়ে হাঁটোবা যা সড়ক পড়ে আছেদেখবে নাম-পরিচয়হীন লাশপুরুষনারীশিশুবোমা থেকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে যারা মারা গেছে। তিনি ভিডিও পাঠিয়েছেনযেসব জায়গায় আমি জীবনের বেশিরভাগটা কাটিয়েছিচেনার উপায় নেইতিনি না বললে বোঝাই যেত না। তিনি বলেনগাজা আর আগের মতো হবে না। আমি মনে মনে বলিআমরাও না।

যুদ্ধ আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে কদর্য মুখটা দেখিয়েছেতবু দেখিয়েছে সত্যিকার মমতা। অন্ধকারতম সময়ে কেউ কেউ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেখাইয়েছেকাঁধ দিয়েছে। তাদের মধ্যে আহমদের পরিবারদীর্ঘদিন আমার আর আমার বোনকে আশ্রয় দিয়েছে। হাতে টানসম্পদ সামান্যতবু বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। তারা আমাদের আগে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে খাবার। আহমদের মাএই ডায়েরিতে দাদি’ নামে আছেননিঃস্বার্থতাদয়াউদারতার জীবন্ত উদাহরণ। এই পরিবার আমাদের জন্য স্রষ্টার পাঠানো উপহার।

যুদ্ধের শুরুতে তারা ছিল অচেনাভাবছিলামদু-একদিন থাকব। আর যেদিন বিদায় নিলামতারা আমাদের পরিবারের মানুষচিরদিনের জন্য হৃদয়ে জায়গা পেল। দক্ষিণ থেকে খবর পাইখাবার নেইটাকা নেইকিছু নেই। তবু যখন আহমদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলিওরা হাসিমুখে বলেভালো আছিসব আছে। উল্টো আমাদের জন্য চিন্তা করে। যুদ্ধের নখ যত গভীরে গেঁথে যায়ততই তারা আরও বেশি ভালোবাসা বিলায়। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করিএই দুঃস্বপ্নটা শেষ হোক।

গাজার যুদ্ধ তেতো ছাড়া কিছু নয়তবু যারা সঙ্গে ছিলতাদের জন্যই কিছুটা সহনীয় হয়েছে। সবার আগে আমার বোনমিশরে পৌঁছে আমি তাকে জড়িয়ে বললামতুমি না থাকলে আমি টিকে উঠতাম না। আমরা দল বেঁধে ছিলামএকসঙ্গে ভেবেছিএকসঙ্গে লড়েছিঅকল্পনীয় দৈনন্দিন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছি। কাছাকাছি এলাকায় ছিটকে পড়া বন্ধুদের নিয়েও তাইএকসঙ্গে জোগাড় করেছি বাঁচার সামগ্রীকথাহাসিতাসযন্ত্রণার ভেতর একটু নিশ্বাস। আর আমার থেরাপিস্টতিনি ফিলিস্তিনি ননপ্রায় প্রতিদিন ইমেল করেছেনআশাবাক্য পাঠিয়েছেনবলেছেনতুমি বাঁচবে। আমি বেশিরভাগ সময় এক লাইনে জবাব দিয়েছি—‘এখনও বেঁচে আছি।’ আর আমার অ-গাজাবাসী বন্ধুরাদিন-রাত খোঁজ নিয়েছে। বহুবার মৃত্যু খুব কাছে ছিলতখন আমি তাদের বলেছিআমি যদি না থাকিআমার পক্ষ থেকে একটা সৎকর্ম করে দিও। সবাই একটাই কথা বলেছে—‘তুমি বাঁচবে।

এখন নিজেকে জিজ্ঞেস করিআমি কেন এখনও লিখছিলিখছিকারণ এই ডায়েরিআমার ফ্ল্যাটের চাবি আর গাজার বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবির মতোইএকটা প্রতীক আর একরকম নিশ্চিতকরণ। ভালোবাসার প্রতীকটিকে থাকার প্রতীকবাঁচার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আমরা কোথায় যে পৌঁছাই না কেনযত দুঃখ-যন্ত্রণা যাই পেরিয়ে আসিগাজায় ফেরার স্বপ্ন কখনো থামবে না। গাজা আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী থাকবে।

অনুগ্রহ করে গাজাবাসীদের জন্য ইতিবাচক চিন্তা আর প্রার্থনায় রাখবেন।

জিওগ্রাফিক্যাল কন্ট্রিবিউটর

জনপ্রিয় সংবাদ

ঢাকা বাজারে সূচক বৃদ্ধি, চট্টগ্রামে পতন

গাজার এক ডায়েরিঃ কেউ কি বলার আমার কাহিনী

০৮:২০:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

রাফাহর এক বাড়ির সামনে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর এক ফিলিস্তিনি বাবা ও তাঁর ছেলেরাএমন ছবির অন্তরাল থেকেই এই লেখা। কে বলবে আমার কাহিনি: গাজার এক ডায়েরি’ বই থেকে নেওয়া একটি অংশত্রিশোর্ধ্ব এক গাজাবাসীর লেখাযিনি ঘরছাড়া হয়ে নির্বাসনে বাস করছেন। দরজাহীন এক চাবিরুটিহীন এক বেকারিস্মৃতিতে পরিণত এক নগর। মিশরে আশ্রয় নেওয়া এই মানুষটি উচ্ছেদপরিচয় ও বেঁচে থাকার এক অনাড়ম্বর দিনলিপি তুলে ধরেছেন। হারিয়ে যাওয়া নিত্যজীবনের প্রতিধ্বনিতাজা ফালাফেলের গন্ধসাগরতীরের ক্যাফের গুঞ্জনশিশুদের খেলাধুলার শব্দএর ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের সাক্ষ্য দিতে ডাকছেন গাজার ধ্বংসস্তূপেরআর সেইসব মানুষের স্থৈর্যেরযারা আজও বুকের ভেতর গল্পগুলো বহন করে চলেছেন।

আমি কোনোদিন ফেরার চাবির ধারণাটা বুঝিনিসেই মরচেধরা তামার চাবি। ১৯৪৮ সালে যারা ঘরছাড়া হয়েছিলেনতাঁদের কাছ থেকে সে চাবি গেছে তাঁদের সন্তানদের হাতেসেখান থেকে নাতিনাতনিদের হাতেএভাবেই প্রজন্মান্তরে। কয়েক বছর আগে মারা যাওয়া আমার এক বন্ধুর নানিযিনি নাজারেথে (আরবিতে আল নাসরা) জন্মেছিলেনবড় হয়েছেনসংসার পেতেছিলেনজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশে শায়িত হওয়ারশেষবার নিজের বাড়ি দেখার আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখেছিলেন। স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি। শেষ বয়সে তাঁর চলাফেরা ছিল কষ্টসাধ্যতবু নাতিনাতনিদের জন্য রান্না করার প্রাণপাত চেষ্টা করতেনতখনও তারা ত্রিশ পেরিয়েছে। আমি যেতামতিনি চেয়ারে বসে থাকতেনআর অন্তরের গভীরে খোদাই হয়ে থাকা জায়গাগুলোর গল্প শোনাতেন। তাঁর চোখে ঝিলিক দেখতামনিজের রান্নাঘরপিকনিকহারিয়ে আসা সেইসব জায়গার কথা বলতে বলতে।

আমারও সেই অনুভূতি বুঝতে সময় লেগেছেপঁয়ত্রিশ বছরেরও বেশি। যখন আমাকেই ঘর ছাড়তে হলোআমার বাড়িআমার রাস্তাআমার শহরআমার দেশ। গাজার দক্ষিণে অসহনীয়যন্ত্রণাময় কয়েক মাসের উদ্বাস্তুজীবন শেষে আমি মিশরে পৌঁছালাম। শরীরটা এসেছেকিন্তু মন-প্রাণ পড়ে রয়েছে ওখানে। ভাড়া বাসায় প্রতি রাতেই আলমারিতে হাত বাড়াইকাপড়-চাদরের ফাঁকে লুকানো পেন্সিলবক্সটা বার করিখুলে দেখি আমার বাড়ির চাবি। জানিতার আর কোনো কাজ নেইভয়াবহ বোমায় দরজাগুলো চূর্ণ হয়ে গেছে। তবু প্রতিবার চাবিটা দেখলেই মনে করাইআশা আছে। কোনো একদিন আমি ফিরবআমার ফ্ল্যাটেআমার রাস্তায়আমার আপনজনদের কাছেআমার গাজায়।

আমি ছোটবেলা থেকেই জানার আগ্রহী ছিলাম। যত জেনেছিততই কখনো না জানলেই বোধহয় ভালো হতোএমন মনে হয়েছে। এই বছর আমাকে শিখিয়েছে—‘পরিচয়’ বলতে কেবল গুণবিশ্বাসআচরণ আর চেহারার সমষ্টি বোঝায় না। আমার ফ্ল্যাটের সেই চাবিটাই এখন আমার পরিচয়ের অংশ। গাজায় প্রতিদিন যেসব পথ ধরে কাজে যেতামবন্ধুর কাছে যেতামসেসব পথও আমার সত্তার অংশ হয়ে গেছে। গন্ধগুলোদৃশ্যগুলোশব্দগুলোসবই আমার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গাজা সিটিতে আল নাসের আর ওয়াহদা সড়কের মোড়ে গেলে পরিবারের বেকারির রুটি-তন্দুরির সুগন্ধে থমকে দাঁড়াতে হতো। ১৯৮৪ সালেচল্লিশ বছর আগেছোট্ট দোকান হিসেবে শুরুমালিক তাঁর সন্তানদের সঙ্গে রুটি বানাতেননিজস্ব গাড়িতে সরবরাহ করতেন। পরে বড় হলোক্রোসাঁমিষ্টিকুকিসব যোগ হলো।

ডায়েট চলার সময় সেই দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়া ছিল নিদারুণ যন্ত্রণা। বন্ধুরা ওই দোকানটিকেই আড্ডার জায়গা বানিয়েছিলামকোথাও যাওয়ার আগে খাবার দিয়ে শুরুপৃথিবীর সেরা শুরু! এক বন্ধু তাদের ডোনাটে প্রেমে পড়লআমার প্রিয় ছিল সিম্পল পাউরুটি। সামান্য জাতার আর অলিভ তেলব্যসপৃথিবীর সেরা স্যান্ডউইচ। পরে শুনলামউৎপাদন লাইন আর সোলার প্যানেলসব বোমায় গুঁড়ো হয়ে গেছে। বেকারি বন্ধ। তাদের ফেসবুক পেজে শেষ পোস্ট ৬ অক্টোবর ২০২৩গ্রাহকদের প্রতি শুভ শুক্রবারের প্রার্থনা।

বেকারির পাশেই আবু তলাল ফালাফেলছোট দোকানবড় ইতিহাস। তাজা গরম ফালাফেলের জন্য লম্বা লাইন। আমার মতে সেরা ফালাফেল আবু তলালযদিও গাজাবাসীর চিরন্তন বিতর্কআবু তলালনাকি আল সউসিআল রিমাল সড়কে ১৯৭৫ সালে শুরু হয়েছিল আল সউসিবছরের পর বছর ডাউনটাউন গাজা’ হয়ে ওঠা সেই এলাকাতেই। সেই ছোট্ট দোকানই থেকে গেছেশত শত মানুষ সকালের নাশতা বা দিনের শেষে স্যান্ডউইচ নিতে লাইনে দাঁড়াত।

যুদ্ধের মাঝেও শুনলামআল সউসি দক্ষিণে ছোট্ট এক মোড়ে আবার ফালাফেল বিক্রি শুরু করেছেফাটা কাগজে নাম লেখা টাঙিয়ে। আমি গেলামযাদের হাতে টাকা আছেযারা কিনতে পারছেতাদের মুখে একরকম আনন্দ দেখলাম। দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও আমি কিনলাম নাঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে ভেবে নয়কাঠের চুলায় ধীরে তেল গরম হচ্ছে বলে নয়বরং জায়গাটা আর আগের জায়গা নয়মানুষগুলোও নয়গন্ধ নয়অনুভবও নয়।

আমি সৌভাগ্যবানগাজা ছাড়তে পেরেছিমিশরে আসতে পেরেছি। আজও বুঝি নাকেন আমার জীবনটা ওখানে আটকে থাকা শিশু-মহিলা-পুরুষদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হলো। আমার পাওনাছাড়ারবাঁচারবেঁচে থাকার। কিন্তু আমি কি সত্যিই বেঁচে আছিমিশর সুন্দরকিন্তু গাজাবাসীর ভেতর ক্ষতত্রাসঅনিশ্চয়তা। লক্ষ মানুষের ভিড়েমিশরীয় বা অন্য দেশেরআমি সহজেই একজন গাজাবাসীকে চিনে ফেলি। চেহারা বা উচ্চারণে নয়আত্মার গায়ে খোদাই হওয়া যন্ত্রণায়। যেন আমাদের শক্তিগুলো একে অন্যকে টেনে নেয়। সেই বিমর্ষবিহ্বলশোকাভিভূত দৃষ্টিভুল হয় না কখনো। আরেকজন গাজাবাসীসব হারিয়ে মাথা তুলে থাকার চেষ্টাবাঁচার চেষ্টাআদৌ পারবে কি নাজানা নেই।

আমি খুব কম বেরোই। পারি না। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা এক পৃথিবীতে নিজেকে ভাবতেই পারি নাকর্মস্থলে যাওয়া মানুষবই হাতে শিশুচারদিকে খাবার। হে ঈশ্বর! সর্বত্র খাবার! এই পৃথিবীতে সবার জন্য যথেষ্ট খাবার আছেতবু গাজাবাসীরা অনাহারে।

মিশরে এসে প্রথম দিকে পাগলের মতো খাবার অর্ডার করতামক্ষুধা না থাকলেও খেতাম। তারপর উল্টোটাখাওয়া বন্ধ। আমার এক বান্ধবী মা-কে নিয়ে মিশরে এসেছেনগাজায় রয়ে গেছে পরিবার-পরিজন। বললেনভীষণ অপরাধবোধ হয়ওরা যা খায়সেও তাই খায়। গাজায় যদি একটা বীনসের ক্যান জোটেসে-ও মিশরে বীনসের ক্যান কিনে খায়যদি আধখানা রুটি ভাগ পড়েসেও আধখানা রুটি খায়। ওরা না খেলেআমি খাই কীভাবেআমি মায়ের জন্য রান্না করিতিনি অসুস্থকিন্তু হাত দিই না। ওরা খেলেআমি খাই। না খেলেআমিও না।

আরেক বন্ধু আমাকে কয়েক বছর আগের এক ছবির কথা মনে করিয়ে দিলতার কাছে আমার পাঠানোকুনাফার তিন থালা। শীতে আমি তিন থালা কুনাফা খেয়ে দিতামচিনি-উল্লাসে। সে বললসাকাল্লাহ বা আবু আল সাউদগাজার বিখ্যাত মিষ্টির দোকানওখানে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমি তাকে কাজেম আইসক্রিমের লেবু স্লাশের ছবি পাঠালাম। বললামএকদিন আবার একসঙ্গে মিষ্টি খাবো।

যে সমাবেশটা মোটেই মিস করি নাবিদায়-আসর। মিশরে এসে যারা কোনো না কোনোভাবে ভিসা জোগাড় করতে পেরেছেতাদের বেশিরভাগই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিছুই তো আর বাকি নেই। আমি চাইলে হয়তো থাকতামকিন্তু আমি চাই না আমার সন্তানরা আমাদের মতো দুঃস্বপ্ন দেখুক। আমরা চেষ্টা করেছিতুমি জানো। তুমি তো আমার দেখা সবচেয়ে ইতিবাচক মানুষ। দেখো তোমাকেতোমার প্রাণশক্তি হারিয়ে গেছেবাঁচার ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। আমি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার ঝুঁকি নিতে পারি না। তাদের জীবন চিরদিনের জন্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছেআর না।’—দশ ও আট বছরের দুই সন্তানের মা-বন্ধুর কথাগুলো। তিনি বাচ্চাদের নিয়ে গাজা থেকে মিশরকিন্তু স্বামী পারেননি। মিশরে থাকার সময়ই স্বামী তাঁর বাবাকে হারানকবর দিতে পারেননি। যুদ্ধের শুরুতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ভিসা পান। মাসের পর মাস দোদুল্যমান থাকার পর কঠিন সিদ্ধান্তদুই সন্তানকে নিয়ে চলে গেলেনপেছন ফিরে না তাকিয়েই।

প্রতিটি বিদায়ের শেষে আমি বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতামকাঁদতামআর বারবার বলতাম—‘যুদ্ধটা ধিকযে আমাদের ছেড়ে দিয়েছে আলাদা করে।’ শেষ বিদায়টা ছিল এক বন্ধুর ভাড়া বাসায়। সে স্পেনে চলে গেছেস্ত্রী আর কন্যার জন্য ভালো জীবন খুঁজতে। সবাই চলে গেলে আমি থেকে গেলাম। আমরা কথা বললামএই পৃথিবী কত নির্মমকেমন করে দূর থেকে আমাদের যন্ত্রণা দেখেও কিছুই করে না। বাবার দুইটা স্বপ্ন ছিলএকটা বাড়ি বানাবেনআর ছয় সন্তানকে তাদের পরিবারসহ কাছাকাছি দেখবেনবার্ধক্যে তাঁদের হাসিখুশি মুখ দেখবেন।’—সে বলল। বাবা স্কুলে পড়াতেনপ্রাইভেট টিউশন করতেনঅমানুষিক পরিশ্রমসন্তানদের ভালো জীবন দিতে। ক্লাসের ফাঁকে বাবা কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে পিঠের অসহনীয় ব্যথার ওষুধ খেতেনআমার বুক ফেটে যেত।’ আজ তাদের বাড়ি নেইভাইবোনেরা সারা বিশ্বে ছিটকে। তার মনে হয়ওরা বুদ্ধিমান ছিলআগেভাগে বুঝেছিল গাজা গাজাবাসীদের জন্য নয়। সে থাকতে চেয়েছিলথাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলশেষ পর্যন্ত বুঝলএখানেও থাকা যায় না। বাড়ি নেইবাবা-মা আর ভাইবোন কেউ একসঙ্গে নেই। বাবার স্বপ্ন শেষ।

আমি নিশ্চিত নই—‘বেঁচে গেছি’ বলা ঠিক কি না। আমি বাঁচিনি। শরীরকিছুটাগাজা থেকে বেরিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় আমি ভালো আছিস্বাভাবিক আছিআগের মানুষটা আছি (তারপরওএই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত যুদ্ধ চলছেই)। আতঙ্ক-আক্রমণ এখন গাজাবাসীর নিত্যসঙ্গী। একবার খুব ব্যস্ত সড়কের ধারেই আতঙ্কে আমার পা ভেঙে পড়লদুপাশ দিয়ে হাজার গাড়ি ছুটছেআমি ফুটপাথে লুটিয়ে কেঁদেছিলাম আধঘণ্টা।

ভয়ানক হলোঘুমের ভেতরেও আতঙ্ক-আক্রমণ হয়। একদিন চোখ মেলা মাত্র মনে পড়ল কী হয়েছে আমাদেরকত বাধা সামনেভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছেঅসহ্য এক ঝাঁপটায়।

আমরা কি কোনোদিন গাজায় ফিরবসব হারিয়ে?
আমরা কি সারাজীবন মিশরেই পড়ে থাকবগাজা তো পাশেই?
আমাদের কি তৃতীয় দেশে ঠেলে দেওয়া হবে?
শূন্য থেকে শুরু করতে হবে?
ধীরে ধীরে জীবনভর সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছেটাকা শেষ হলে কী হবে?
জানিআমার কিছু বন্ধু পরিবারসহ মারা গেছেহে ঈশ্বরতারা সত্যিই নেই। আর কখনো দেখব না। আমি নিজেকে প্রতারিত করিভাবিযুদ্ধ থামলেথামলে যদিদেখা হবে। কিন্তু তারা তো মৃত। আমি কি কোনোদিন বাবা-মায়ের কবর দেখতে পারবকবরগুলো কি অক্ষত আছেবোমায় উড়ে গেছে কি?

বিছানা থেকে উঠে আতঙ্কে কাঁপছিলাম। এক বন্ধুকে ফোন করলামসে বললআবার আতঙ্ক-আক্রমণ হচ্ছে। আমরা কথা বললাম এক ঘণ্টা। সত্যি বলতেআমিই কথা বললামসে থেরাপিস্টের মতো শান্ত রাখল।

সামান্য জিনিসও ট্রিগার হয়। এক বন্ধু দীর্ঘদিন পর ছুটি জুটিয়ে দুই দেশ ঘুরে আমার কাছে এলোহাতে কয়েকটা উপহার। পৌঁছে সে চমকে দিতে চাইলতার এক বন্ধুকে দিয়ে আমাকে নিচে ডাকাল। নেমে দেখিদুটো গাছএকটা বড়একটা ছোট। আমরা জড়িয়ে ধরলামকথা বললামকিন্তু আমার মাথা গাছেই আটকেআমি কি ওদের দেখভাল করতে পারবএক বছরের বেশি সময় ধরে নিজের দেখভাল করাই দুঃসাধ্যবেঁচে থাকা কঠিন। কিছুদিন তো বিছানা ছাড়াই সম্ভব নয়খাওয়া-দাওয়াএখন কি আরেকটা জীবন্ত জিনিসের দায়পরদিন ঘুম থেকে উঠেই ছুটে বারান্দায় গেলামগাছ দুটো কেমন আছে। পানি দেওয়াবড় বোঝা। যদি ভুলে যাইএই ভাবনাই দুশ্চিন্তা।

বন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে চেপে এক ঘণ্টার দূরত্বের এক রেস্তোরাঁয় যাচ্ছিলামসে নিশ্চিত ছিলজায়গাটা আমার ভালো লাগবে। হঠাৎ আমি কেঁদে ফেললামসেও কাঁদল। মিনতি করলকী হয়েছে বলি। চেনা মানুষ মারা যায়বারবার। প্রতিদিন নতুন স্বপ্ন নিভে যায়। আমার প্রাণ শুকিয়ে গেছে। আমরা শেষ। আর পারছি না। আমি ভীষণ ক্লান্তঅসহায়দুর্বল।’ আমি বললামআমি আর বাঁচি নাশরীর চলছেভেতরটা মৃত। বাইরে যেতে চাই নানতুন মানুষ চিনতে চাই নাখাচ্ছি নারেস্তোরাঁয়ও যেতে চাই না। সে চালককে থামাতে বলল। আমরা নেমে নাইলের পাড়ে মাটিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললাম।

নাইল সুন্দরতবু আমার মনে পড়ে গাজার সাগর। মাহমুদ দারবিশ একটি কবিতায় লিখেছিলেন
গাজা সবচেয়ে সুন্দর শহর নয়।
এর তীর আরব শহরগুলোর তীরের চেয়ে নীলতর নয়।
এর কমলালেবু ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে সুন্দর নয়।
গাজা সবচেয়ে ধনী শহর নয়।
তার তীর নিঃসন্দেহে সবচেয়ে নীল নয়কিন্তু ওটাই আমার তীর। সমুদ্রতটের বালু জানেবন্ধুদের সঙ্গে কত হাঁটাহাঁটিকত গভীর আলাপহাসি-কান্না মেশানো। সাগরের ধারে একটা ক্যাফে ছিলমাঝে মাঝে আমরা জমতাম। দুপুর আনতামখেলা খেলতামছবি তুলতাম। একবার রমজানে ঠিক করলামসেই ক্যাফেতেই ইফতার। খাবার অর্ডার দিলামমাগরিবের এক ঘণ্টা আগে সবাই জড়ো। কিন্তু খাবার এল দেরিতেআর অর্ডারের অর্ধেক নেই। মনে আছেখ্রিস্টান বন্ধুরা গাড়ি নিয়ে ছুটলখালি হাতে ফিরবে না কথা দিয়ে। আমরা উপোসতবু যাদের খাবার এসে গেছেকেউ মুখে দিচ্ছি নাযতক্ষণ না সবাই পায়। চল্লিশ মিনিট পর তারা ফিরে এলবিজয়ীর হাসিহাতে উঁচু করে দেখাল খাবার। আমরা তাদের নায়কের মতো অভিনন্দন জানালাম!

হ্যাঁগাজা সবচেয়ে সুন্দর শহর নয়তবু এ শহরেই অনেকে প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছেশিশুদের ঘুড়ি উড়েছেমানুষ ব্যবসা শুরু করেছেসাফল্য দেখেছে। গাজার বুকে অসংখ্য স্তরে চাপা পড়ে আছে লক্ষ-লক্ষ গল্পসবাই বলার যোগ্য।

আমি যে গাজাকে চিনিসেখানে মসজিদ আর গির্জা পাশাপাশি। গাজার প্রাচীনতম সেন্ট পারফিরিয়ুস গির্জাএক দেয়াল ভাগ করে আছে মসজিদের সঙ্গে। বড় ক্রুশটা মসজিদের মিনারের সমান্তরালে। আমি যে গাজাকে চিনিসেখানে বহু মুসলমান বড়দিনে ওয়াইএমসিএ-তে গাছ আলোর উৎসব দেখে আনন্দ করে। আমি যে গাজাকে চিনিসেখানে খ্রিস্টানরা পুরো রমজানজুড়ে উপবাস করেছে মুসলিম বন্ধুদের সংহতিতেএকসঙ্গে ইফতার করেছে। যুদ্ধের ভয়াল দিনে গির্জা আশ্রয় দিয়েছেখ্রিস্টান-মুসলমান নির্বিশেষেবাড়িছাড়া মানুষদের। দুর্ভাগ্যসেন্ট পারফিরিয়ুস গির্জা বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেগাজার প্রাচীনতম আল উমারি মসজিদপঞ্চম শতকে নির্মিতসেটিও ধ্বংস হয়েছে।

বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সে বললতার বাড়ির ক্রিসমাস ট্রিটাকে বড্ড মিস করে। আমিও বললামআমার ট্রির কথা। আমরা দুজনেই মুসলমানতবু ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিট্রি ছিল ঘরের প্রাণ। দুদিন পর গুগল ফটোস আমাকে পুরোনো একটা সেলফি দেখালট্রির পাশে দাঁড়িয়ে। আমি পাঠালাম ওকে।

গুগল ফটোস একরকম ইতিহাসের খাতা। আমার এক বন্ধু আগে বিরক্ত হতোআমি এত ছবি তুলি বলে। এখনআমাদের বন্ধুমহল ছিটকে পড়েছেকেউ গাজায় আটককেউ মিশরেবাকিরা নানা দেশেসে কৃতজ্ঞ—‘তুমিই তো এই ছবিগুলো পাঠিয়েছিলেএগুলো আমাদের ভালো দিনের স্মারক। কখনো ভাবিনিএকসঙ্গে বসার সুযোগই আর হবে না।

একজন পরিচিতযিনি গাজাতেই আছেনবললেনআজ যদি সড়ক দিয়ে হাঁটোবা যা সড়ক পড়ে আছেদেখবে নাম-পরিচয়হীন লাশপুরুষনারীশিশুবোমা থেকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে যারা মারা গেছে। তিনি ভিডিও পাঠিয়েছেনযেসব জায়গায় আমি জীবনের বেশিরভাগটা কাটিয়েছিচেনার উপায় নেইতিনি না বললে বোঝাই যেত না। তিনি বলেনগাজা আর আগের মতো হবে না। আমি মনে মনে বলিআমরাও না।

যুদ্ধ আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে কদর্য মুখটা দেখিয়েছেতবু দেখিয়েছে সত্যিকার মমতা। অন্ধকারতম সময়ে কেউ কেউ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেখাইয়েছেকাঁধ দিয়েছে। তাদের মধ্যে আহমদের পরিবারদীর্ঘদিন আমার আর আমার বোনকে আশ্রয় দিয়েছে। হাতে টানসম্পদ সামান্যতবু বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। তারা আমাদের আগে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে খাবার। আহমদের মাএই ডায়েরিতে দাদি’ নামে আছেননিঃস্বার্থতাদয়াউদারতার জীবন্ত উদাহরণ। এই পরিবার আমাদের জন্য স্রষ্টার পাঠানো উপহার।

যুদ্ধের শুরুতে তারা ছিল অচেনাভাবছিলামদু-একদিন থাকব। আর যেদিন বিদায় নিলামতারা আমাদের পরিবারের মানুষচিরদিনের জন্য হৃদয়ে জায়গা পেল। দক্ষিণ থেকে খবর পাইখাবার নেইটাকা নেইকিছু নেই। তবু যখন আহমদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলিওরা হাসিমুখে বলেভালো আছিসব আছে। উল্টো আমাদের জন্য চিন্তা করে। যুদ্ধের নখ যত গভীরে গেঁথে যায়ততই তারা আরও বেশি ভালোবাসা বিলায়। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করিএই দুঃস্বপ্নটা শেষ হোক।

গাজার যুদ্ধ তেতো ছাড়া কিছু নয়তবু যারা সঙ্গে ছিলতাদের জন্যই কিছুটা সহনীয় হয়েছে। সবার আগে আমার বোনমিশরে পৌঁছে আমি তাকে জড়িয়ে বললামতুমি না থাকলে আমি টিকে উঠতাম না। আমরা দল বেঁধে ছিলামএকসঙ্গে ভেবেছিএকসঙ্গে লড়েছিঅকল্পনীয় দৈনন্দিন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছি। কাছাকাছি এলাকায় ছিটকে পড়া বন্ধুদের নিয়েও তাইএকসঙ্গে জোগাড় করেছি বাঁচার সামগ্রীকথাহাসিতাসযন্ত্রণার ভেতর একটু নিশ্বাস। আর আমার থেরাপিস্টতিনি ফিলিস্তিনি ননপ্রায় প্রতিদিন ইমেল করেছেনআশাবাক্য পাঠিয়েছেনবলেছেনতুমি বাঁচবে। আমি বেশিরভাগ সময় এক লাইনে জবাব দিয়েছি—‘এখনও বেঁচে আছি।’ আর আমার অ-গাজাবাসী বন্ধুরাদিন-রাত খোঁজ নিয়েছে। বহুবার মৃত্যু খুব কাছে ছিলতখন আমি তাদের বলেছিআমি যদি না থাকিআমার পক্ষ থেকে একটা সৎকর্ম করে দিও। সবাই একটাই কথা বলেছে—‘তুমি বাঁচবে।

এখন নিজেকে জিজ্ঞেস করিআমি কেন এখনও লিখছিলিখছিকারণ এই ডায়েরিআমার ফ্ল্যাটের চাবি আর গাজার বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবির মতোইএকটা প্রতীক আর একরকম নিশ্চিতকরণ। ভালোবাসার প্রতীকটিকে থাকার প্রতীকবাঁচার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আমরা কোথায় যে পৌঁছাই না কেনযত দুঃখ-যন্ত্রণা যাই পেরিয়ে আসিগাজায় ফেরার স্বপ্ন কখনো থামবে না। গাজা আমাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী থাকবে।

অনুগ্রহ করে গাজাবাসীদের জন্য ইতিবাচক চিন্তা আর প্রার্থনায় রাখবেন।

জিওগ্রাফিক্যাল কন্ট্রিবিউটর