০৯:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি-১১৩) যাদুকাটায় বালু লুটের মহোৎসব চীনবিরোধী বিক্ষোভ দক্ষিণ কোরিয়ার মানবাধিকার ভণ্ডামি উন্মোচন করেছে ভিক্টোরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুধ খামার বিক্রয়: লাভজনক সুযোগ এবং সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য গঠনমূলক পদক্ষপে ভালো স্মৃতি চাই? আগে ‘স্মৃতি’ বলতে কী বোঝায় তা নতুন করে ভাবুন দক্ষিণ আফ্রিকার রহস্যময় ও বিস্ময়কর রিংখালস সাপ প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩১১) এই সপ্তাহে কী দেখবেন–শুনবেন: বিগেলোর থ্রিলার, স্টিলারের পারিবারিক ডক, কারলাইল–লোভাটো ব্রডওয়েতে ‘রাগটাইম’ মঞ্চায়ন: শক্তিশালী সুর ও আবেগের পরিপূরক স্মৃতি দ্রুত মলিন হয়ে যায় কিন্তু ফটোগ্রাফি মুহূর্তটিকে থামিয়ে দিতে পারে

কাশ্মিরি পণ্ডিত শিক্ষক দেহে উপত্যকা ছাড়লেও মনে নয়

শ্রীনগর: প্রিয় শিক্ষক। নির্বাসিত আত্মা। ইসলামিয়া হাইস্কুল শ্রীনগরের সাবেক প্রধান শিক্ষক হৃদয় নাথ কৌল আর নেই। গত ১০ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদে তিনি ৯৩ বছর বয়সে মারা যান। ঝেলম নদীর তীরে বানা মহল্লার বাসিন্দা হলেও তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাশ্মিরকে হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন।

স্মরণ ও শ্রদ্ধাঞ্জলি

তাঁর মৃত্যুর পর নানা জায়গা থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। হুররিয়াত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ উমর ফারুক দীর্ঘ এক শোকবার্তা লিখে বলেন, ইসলামিয়া স্কুলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্র গড়ে তুলতে কৌলের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি মনে করিয়ে দেন, অঞ্জুমান নুসরাতুল ইসলাম স্কুলগুলোতে কাশ্মিরি পণ্ডিত শিক্ষকেরা এমনকি মুসলিম ছাত্রদের নামাজের জন্য জামা মসজিদে উপস্থিতির হাজিরা পর্যন্ত দিতেন—যা তাদের পারস্পরিক বন্ধন ও অভিন্ন মূল্যবোধের প্রমাণ।

শিকড় ও শিক্ষাজীবন

হৃদয় নাথ কৌল ছিলেন পুরোনো শ্রীনগরের সন্তান। তিনি গান্ধী মেমোরিয়াল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি নেন। প্রবীণ মিরওয়াইজের সুপারিশে ষাটের দশকে ইসলামিয়া স্কুলে যোগ দেন। ১৮৬৬ সালে মিরওয়াইজ পরিবারের প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে তাঁর আজীবনের আবাস। কৌল কখনো বিয়ে করেননি; ছাত্রদের শিক্ষা আর গণিতের জগৎকেই তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

নির্বাসনের বেদনা

১৯৯০-এর দশকে কাশ্মিরি পণ্ডিতদের নির্বাসন কৌলের জীবনকেও ভেঙে দেয়। তাঁর ভাতিজা কার্তিক কৌল, যিনি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক জেনারেল ম্যানেজার, বলেন—১৯৮৯ সালে জেকেএলএফ রুবাইয়া সাঈদকে অপহরণের পর পরিবার উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হয়। প্রথমে জম্মুর মিরান সাহিবে আশ্রয়, তারপর মাইগ্র্যান্ট ক্যাম্প, তাঁবুর বসতি, পরে পুনে, কানপুর, হায়দরাবাদ—চাকরির টানে যেখানেই যাওয়া, বড়বাবা সবসময় তাদের সঙ্গে ছিলেন। প্রায় ১৭ বছর তাঁরা জম্মুতেই কাটান।
কার্তিক বলেন, এই মাইগ্রেশন তাঁর চাচার মন ভেঙে দিয়েছিল। দেহে তিনি পরিবারে ছিলেন, কিন্তু আত্মা সবসময় কাশ্মিরেই ছিল।

শেষ ইচ্ছা ও বেদনাদায়ক বাস্তবতা

হৃদয় নাথ কৌলের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর বইগুলো ফিরে পাওয়া, বিশেষ করে একটি হাতে লেখা কোরআন, যা আশির দশকে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে কার্তিক পুরোনো বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি আর ছিল না। ভাতিজা যখন খবরটি জানায়, তাঁর কষ্ট আরও বেড়ে যায়।
কৌল ইসলামিয়া স্কুল থেকে শেষ ছয় মাসের বেতন তোলেননি। পরিবারকেও তিনি কোনো আবেদন না করার নির্দেশ দেন।

শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে

তাঁর ছাত্ররা বলেন, গণিতের পাশাপাশি মাঝে মধ্যে তিনি দীনিয়াতসহ ইসলামী বিষয়ও পড়াতেন। একজন প্রাক্তন ছাত্রের ভাষায়, “আমি ওনার সবকিছু মনে করতে পারি না, তবে মনে আছে মাঝে মাঝে দীনিয়াতও শেখাতেন।”

হৃদয় নাথ কৌল শরীরে উপত্যকা ছেড়েছিলেন, কিন্তু হৃদয়ে আজীবন বয়ে বেড়িয়েছিলেন কাশ্মিরকে।

জনপ্রিয় সংবাদ

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি-১১৩)

কাশ্মিরি পণ্ডিত শিক্ষক দেহে উপত্যকা ছাড়লেও মনে নয়

১২:২২:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শ্রীনগর: প্রিয় শিক্ষক। নির্বাসিত আত্মা। ইসলামিয়া হাইস্কুল শ্রীনগরের সাবেক প্রধান শিক্ষক হৃদয় নাথ কৌল আর নেই। গত ১০ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদে তিনি ৯৩ বছর বয়সে মারা যান। ঝেলম নদীর তীরে বানা মহল্লার বাসিন্দা হলেও তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাশ্মিরকে হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন।

স্মরণ ও শ্রদ্ধাঞ্জলি

তাঁর মৃত্যুর পর নানা জায়গা থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। হুররিয়াত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ উমর ফারুক দীর্ঘ এক শোকবার্তা লিখে বলেন, ইসলামিয়া স্কুলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্র গড়ে তুলতে কৌলের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি মনে করিয়ে দেন, অঞ্জুমান নুসরাতুল ইসলাম স্কুলগুলোতে কাশ্মিরি পণ্ডিত শিক্ষকেরা এমনকি মুসলিম ছাত্রদের নামাজের জন্য জামা মসজিদে উপস্থিতির হাজিরা পর্যন্ত দিতেন—যা তাদের পারস্পরিক বন্ধন ও অভিন্ন মূল্যবোধের প্রমাণ।

শিকড় ও শিক্ষাজীবন

হৃদয় নাথ কৌল ছিলেন পুরোনো শ্রীনগরের সন্তান। তিনি গান্ধী মেমোরিয়াল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি নেন। প্রবীণ মিরওয়াইজের সুপারিশে ষাটের দশকে ইসলামিয়া স্কুলে যোগ দেন। ১৮৬৬ সালে মিরওয়াইজ পরিবারের প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে তাঁর আজীবনের আবাস। কৌল কখনো বিয়ে করেননি; ছাত্রদের শিক্ষা আর গণিতের জগৎকেই তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

নির্বাসনের বেদনা

১৯৯০-এর দশকে কাশ্মিরি পণ্ডিতদের নির্বাসন কৌলের জীবনকেও ভেঙে দেয়। তাঁর ভাতিজা কার্তিক কৌল, যিনি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক জেনারেল ম্যানেজার, বলেন—১৯৮৯ সালে জেকেএলএফ রুবাইয়া সাঈদকে অপহরণের পর পরিবার উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হয়। প্রথমে জম্মুর মিরান সাহিবে আশ্রয়, তারপর মাইগ্র্যান্ট ক্যাম্প, তাঁবুর বসতি, পরে পুনে, কানপুর, হায়দরাবাদ—চাকরির টানে যেখানেই যাওয়া, বড়বাবা সবসময় তাদের সঙ্গে ছিলেন। প্রায় ১৭ বছর তাঁরা জম্মুতেই কাটান।
কার্তিক বলেন, এই মাইগ্রেশন তাঁর চাচার মন ভেঙে দিয়েছিল। দেহে তিনি পরিবারে ছিলেন, কিন্তু আত্মা সবসময় কাশ্মিরেই ছিল।

শেষ ইচ্ছা ও বেদনাদায়ক বাস্তবতা

হৃদয় নাথ কৌলের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর বইগুলো ফিরে পাওয়া, বিশেষ করে একটি হাতে লেখা কোরআন, যা আশির দশকে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে কার্তিক পুরোনো বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি আর ছিল না। ভাতিজা যখন খবরটি জানায়, তাঁর কষ্ট আরও বেড়ে যায়।
কৌল ইসলামিয়া স্কুল থেকে শেষ ছয় মাসের বেতন তোলেননি। পরিবারকেও তিনি কোনো আবেদন না করার নির্দেশ দেন।

শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে

তাঁর ছাত্ররা বলেন, গণিতের পাশাপাশি মাঝে মধ্যে তিনি দীনিয়াতসহ ইসলামী বিষয়ও পড়াতেন। একজন প্রাক্তন ছাত্রের ভাষায়, “আমি ওনার সবকিছু মনে করতে পারি না, তবে মনে আছে মাঝে মাঝে দীনিয়াতও শেখাতেন।”

হৃদয় নাথ কৌল শরীরে উপত্যকা ছেড়েছিলেন, কিন্তু হৃদয়ে আজীবন বয়ে বেড়িয়েছিলেন কাশ্মিরকে।