০৬:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

টাকার অতিমূল্যায়ন: রপ্তানি প্রতিযোগিতা হারানোর শঙ্কা

বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা ক্রমেই অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ছে। আমদানি চাহিদা দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমুখী, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহও দুর্বল। এর বিপরীতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ শক্তিশালী থাকায় টাকার প্রকৃত মান কৃত্রিমভাবে উঁচুতে ঠেকছে।

রিইআর সূচকের ইঙ্গিত

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, বাস্তব কার্যকর বিনিময় হার (REER) সূচক চলতি বছরের আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৩.৮৪-এ, যা এক মাস আগে ছিল ১০১.২৩।
এই সূচকটি ১৫টি প্রধান বাণিজ্য অংশীদারের মুদ্রার বিপরীতে টাকার অবস্থান পরিমাপ করে। সূচক ১০০-এর নিচে থাকলে রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়ে, আর ১০০-এর ওপরে মানে মুদ্রার দাম সমতা অবস্থার তুলনায় বেশি—যা রপ্তানির জন্য ক্ষতিকর এবং আমদানি সস্তা করে তোলে।

টাকার অতিমূল্যায়ন

২০২৫ সালের আগস্টের হিসাব অনুযায়ী, এক ডলারের দাম হওয়া উচিত ছিল ১২৬ টাকা ৩১ পয়সা। বাস্তবে বাজারে ডলার বিক্রি হয়েছে ১২১ টাকা ৬৪ পয়সায়। ফলে টাকার দাম ডলারের তুলনায় প্রায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা বেশি ধরা পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনছে যাতে এই ব্যবধান আরও না বাড়ে। জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজার থেকে কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ঋণ প্রবাহ ও আমদানি চাহিদা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল, যার ফলে আমদানি কমছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক থাকছে।
তাদের ভাষায়, “ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। আমরা বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করব না, তবে প্রয়োজনে ডলার কিনে পার্থক্য সীমিত রাখব।”

অর্থনীতিবিদদের সতর্কতা

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, টাকার এই অতিমূল্যায়ন বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা নষ্ট করছে। নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম. মাসরুর রিয়াজ বলেন, “এরই মধ্যে রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, রিইআর বাড়ায় অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিও অংশীদার দেশগুলোর তুলনায় বেশি হচ্ছে। তবে তার আশাবাদ, সামনের মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে পারে।

নির্বাচনের পর চিত্র

ড. রিয়াজের মতে, সাধারণ নির্বাচন শেষে আমদানি চাহিদা আবার বাড়বে এবং বেসরকারি খাতে কার্যক্রম—যা অর্থনীতির আসল চালিকাশক্তি—পুনরুজ্জীবিত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ৬.৫২ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় খুবই কম। জুনের তুলনায় এ প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ০.২৯ শতাংশ।

বিনিয়োগে স্থবিরতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আখতার হোসেন বলেন, আমদানির নিম্নগতি আসলে বিনিয়োগ স্থবিরতার প্রতিফলন। “একবার বেসরকারি বিনিয়োগ গতি পেলে আমদানি বাড়বে, তখন মুদ্রার ভারসাম্যও ফিরবে,” তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, দেশীয় সঞ্চয় বহু বছর ধরে জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশে স্থির রয়েছে, আর বিনিয়োগও ৩০ শতাংশে আটকে আছে। “বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) জরুরি। আমরা মরিয়া হয়ে তা চাইছি, কারণ এ ছাড়া প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে না।”

প্রবাসী আয়ের ভূমিকা

ড. হোসেনের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার প্রাচুর্য টাকার অতিমূল্যায়নের অন্যতম প্রধান কারণ। এর বড় উৎস হলো প্রবাসী আয়।
২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩০ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। এই প্রবাহ অর্থনীতিতে স্বস্তি আনলেও মুদ্রার কৃত্রিম শক্তি রপ্তানিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

টাকার অতিমূল্যায়ন: রপ্তানি প্রতিযোগিতা হারানোর শঙ্কা

১২:৫৮:৫৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা ক্রমেই অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ছে। আমদানি চাহিদা দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমুখী, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহও দুর্বল। এর বিপরীতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ শক্তিশালী থাকায় টাকার প্রকৃত মান কৃত্রিমভাবে উঁচুতে ঠেকছে।

রিইআর সূচকের ইঙ্গিত

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, বাস্তব কার্যকর বিনিময় হার (REER) সূচক চলতি বছরের আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৩.৮৪-এ, যা এক মাস আগে ছিল ১০১.২৩।
এই সূচকটি ১৫টি প্রধান বাণিজ্য অংশীদারের মুদ্রার বিপরীতে টাকার অবস্থান পরিমাপ করে। সূচক ১০০-এর নিচে থাকলে রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়ে, আর ১০০-এর ওপরে মানে মুদ্রার দাম সমতা অবস্থার তুলনায় বেশি—যা রপ্তানির জন্য ক্ষতিকর এবং আমদানি সস্তা করে তোলে।

টাকার অতিমূল্যায়ন

২০২৫ সালের আগস্টের হিসাব অনুযায়ী, এক ডলারের দাম হওয়া উচিত ছিল ১২৬ টাকা ৩১ পয়সা। বাস্তবে বাজারে ডলার বিক্রি হয়েছে ১২১ টাকা ৬৪ পয়সায়। ফলে টাকার দাম ডলারের তুলনায় প্রায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা বেশি ধরা পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনছে যাতে এই ব্যবধান আরও না বাড়ে। জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজার থেকে কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ঋণ প্রবাহ ও আমদানি চাহিদা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল, যার ফলে আমদানি কমছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক থাকছে।
তাদের ভাষায়, “ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। আমরা বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করব না, তবে প্রয়োজনে ডলার কিনে পার্থক্য সীমিত রাখব।”

অর্থনীতিবিদদের সতর্কতা

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, টাকার এই অতিমূল্যায়ন বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা নষ্ট করছে। নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম. মাসরুর রিয়াজ বলেন, “এরই মধ্যে রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, রিইআর বাড়ায় অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিও অংশীদার দেশগুলোর তুলনায় বেশি হচ্ছে। তবে তার আশাবাদ, সামনের মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে পারে।

নির্বাচনের পর চিত্র

ড. রিয়াজের মতে, সাধারণ নির্বাচন শেষে আমদানি চাহিদা আবার বাড়বে এবং বেসরকারি খাতে কার্যক্রম—যা অর্থনীতির আসল চালিকাশক্তি—পুনরুজ্জীবিত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ৬.৫২ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় খুবই কম। জুনের তুলনায় এ প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ০.২৯ শতাংশ।

বিনিয়োগে স্থবিরতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আখতার হোসেন বলেন, আমদানির নিম্নগতি আসলে বিনিয়োগ স্থবিরতার প্রতিফলন। “একবার বেসরকারি বিনিয়োগ গতি পেলে আমদানি বাড়বে, তখন মুদ্রার ভারসাম্যও ফিরবে,” তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, দেশীয় সঞ্চয় বহু বছর ধরে জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশে স্থির রয়েছে, আর বিনিয়োগও ৩০ শতাংশে আটকে আছে। “বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) জরুরি। আমরা মরিয়া হয়ে তা চাইছি, কারণ এ ছাড়া প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে না।”

প্রবাসী আয়ের ভূমিকা

ড. হোসেনের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার প্রাচুর্য টাকার অতিমূল্যায়নের অন্যতম প্রধান কারণ। এর বড় উৎস হলো প্রবাসী আয়।
২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩০ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। এই প্রবাহ অর্থনীতিতে স্বস্তি আনলেও মুদ্রার কৃত্রিম শক্তি রপ্তানিতে চাপ সৃষ্টি করছে।