সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ওজন কমানোর ওষুধ তৈরি করা কোম্পানিগুলো নিজেরাই যেন হঠাৎ ভর হারাতে শুরু করেছে। জুলাইয়ের শেষে ডেনমার্কের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি নোভো নরডিস্ক, যারা বিশ্বকে ওজেম্পিক দিয়েছে, একদিনেই তাদের বাজারমূল্যের এক-চতুর্থাংশ হারায় যখন তারা বিক্রি ও মুনাফার পূর্বাভাস কমায়। তার এক সপ্তাহ পর আমেরিকার জায়ান্ট কোম্পানি এলি লিলির শেয়ারমূল্য ১৪ শতাংশ পড়ে যায়—২৫ বছরে তাদের সবচেয়ে বড় একদিনের পতন।
গত ৬৩ সপ্তাহে, এই দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ শীর্ষমূল্য থেকে তারা প্রায় ৩৫ শতাংশ হারিয়েছে, অর্থাৎ প্রায় অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়েছে। নোভো নরডিস্কের প্রধান নির্বাহীও পদত্যাগ করেছেন, তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আমেরিকার বাইরের ব্যবসার প্রধান।
আমেরিকায় বিক্রি কমে যাওয়ার ধাক্কা
নোভো নরডিস্কের পতনের মূল কারণ আমেরিকার বাজারে বিক্রি কমে যাওয়া। ওজেম্পিক—যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ২০১৭ সালে অনুমোদিত হয়েছিল—এবং ওজন কমানোর জন্য তৈরি ভ্যারিয়েন্ট ওয়েগোভি, ২০২১ সালে বাজারে আসে। এগুলো প্রথম এফডিএ অনুমোদিত ব্লকবাস্টার ওষুধ হলেও, এলি লিলি ২০২২ ও ২০২৩ সালে মাউঞ্জারো এবং জেপ-বাউন্ড নামের আরও কার্যকর জিএলপি-১ ওষুধ চালু করার পর ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে নোভোর প্রতি আগ্রহ কমতে শুরু করে।
অন্যদিকে, এলি লিলির সাম্প্রতিক আর্থিক ফলাফল ভালো হলেও নতুন পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে তাদের নতুন ট্যাবলেট প্রত্যাশার মতো কার্যকর নয়।
প্রতিযোগিতা বাড়ছে, নকল ওষুধের বাজারও জমজমাট
প্রথম দিকে উৎপাদন ঘাটতির কারণে ওয়েগোভির সংকট দেখা দেয়। এ সুযোগে আমেরিকার অনেক ‘কম্পাউন্ডিং ফার্মেসি’ কম দামে একই ধরনের নকল ওষুধ সরবরাহ করতে থাকে। নোভো নরডিস্ক জানাচ্ছে, আমেরিকায় বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ অ্যান্টি-ওবেসিটি প্রেসক্রিপশন এসব ফার্মেসি পূরণ করছে।
একই সময়ে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীরাও এগিয়ে আসছে। সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে ফাইজার ঘোষণা দেয় তারা ৭.৩ বিলিয়ন ডলারে মেটসেরা নামের একটি বায়োটেক কোম্পানি কিনছে, যারা নতুন প্রজন্মের ওজন কমানোর ওষুধ তৈরি করছে। একই দিনে সুইস কোম্পানি রোশ জানায় তারা আগামী বছর থেকে নতুন একটি পরীক্ষার শেষ ধাপ শুরু করবে। এর আগে তারা ৫.৩ বিলিয়ন ডলারে জিল্যান্ড নামের ডেনিশ কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করে। চীনের ইনোভেন্টও সম্প্রতি তাদের নিজস্ব জিএলপি-১ ইনজেকশন অনুমোদন পেয়েছে।
উৎপাদন ক্ষমতায় এগিয়ে নোভো ও লিলি
তবু পরিস্থিতি একেবারে হতাশাজনক নয়। নোভো ও লিলি দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতায় অনেক এগিয়ে। গত চার বছরে নোভো নরডিস্ক ২৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে। ডিসেম্বর মাসে তারা ১৬.৫ বিলিয়ন ডলারে আমেরিকান কোম্পানি ক্যাটালেন্ট কিনে নিয়েছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ উৎপাদন আরও বাড়ানো যায়।
একই সময়ে এলি লিলি প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যদিও তা পুরোপুরি জিএলপি-১ উৎপাদনে নয়। তবে এটি রোশ বা ফাইজারের দ্বিগুণ বিনিয়োগ।
নকল ওষুধ দমনে কড়া ব্যবস্থা
উৎপাদন বাড়া এবং আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর ফলে নকল ওষুধ তৈরির প্রবণতা কমতে পারে। নোভো নরডিস্ক আমেরিকায় ইতিমধ্যে ১৩০টি মামলা করেছে নকল ওষুধ প্রতিরোধে, যার মধ্যে ৪৪টিতে তারা জিতেছে। এফডিএও শিগগিরই এসব কম্পাউন্ডিং ফার্মেসির বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে, বিশেষত যেগুলো চীনা কারখানা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করছে।
নতুন ওষুধের সম্ভাবনা
প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার দ্বিতীয় শক্তি হলো নতুন পণ্য উন্নয়ন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নোভো জানায়, ওয়েগোভির ট্যাবলেট সংস্করণও কার্যকারিতায় ইনজেকশনের সমান। এলি লিলির ট্যাবলেট কিছুটা কম কার্যকর হলেও খাওয়ার আগে উপবাস থাকার দরকার হয় না এবং এটি তৈরি করতেও সস্তা। দুটো কোম্পানিই আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এফডিএ অনুমোদন আশা করছে।
নোভো আরও জানিয়েছে, কাগ্রিলিনটাইড নামের একটি নতুন ইনজেকশন তুলনামূলক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওজন কমাতে সক্ষম। এছাড়া কাগ্রিলিনটাইড ও সেমাগ্লুটাইডের মিশ্রণ, ‘কাগ্রি-সেমা’, আরও কার্যকর ফল দিচ্ছে। এলি লিলির পরীক্ষামূলক ওষুধ রেটাট্রুটাইডও ভালো সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
ভবিষ্যতের বাজার
বর্তমানে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীর ওষুধগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, এবং ২০২৮ সালের আগে অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর মানে, ২০৩০ সালের মধ্যে স্থূলতা চিকিৎসায় বছরে যে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে, তার বড় অংশই যাবে নোভো নরডিস্ক ও এলি লিলির হাতে।
এরপর হয়তো নতুন প্রতিযোগীরা বাজার ভাগ করতে পারবে। তবে ততদিন পর্যন্ত, এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাজার দখলের লড়াই চলতেই থাকবে।