আমেরিকার শেয়ারবাজারে ব্যক্তির প্রভাব
আমেরিকার শেয়ারবাজারে মূল্য ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এখন অবিশ্বাস্য পর্যায়ে। সবচেয়ে মূল্যবান দশ কোম্পানির মধ্যে চারটির নিয়ন্ত্রণ সেই প্রতিষ্ঠাতাদের হাতেই—অ্যালফাবেট, বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে, মেটা ও ওরাকল। টেসলার শেয়ার ক্রমাগত এলন মাস্কের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সবচেয়ে মূল্যবান প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জেনসেন হুয়াং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন। এমন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, “তুমি পৃথিবী দখল করে নিচ্ছ।”

তারকাখ্যাতির বিস্তার
এই প্রভাব কেবল বড় কর্পোরেশনের মধ্যেই সীমিত নয়। প্রোগ্রামার, হেজ ফান্ড ম্যানেজার, লেখক বা গায়ক—সব ক্ষেত্রেই তারকা ব্যক্তির প্রভাব ও আয়ের হার আকাশচুম্বী। রাজনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীদের দিকে নজর রাখলেও, বাস্তবে শ্রমবাজারে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটছে অতিশয় প্রতিভাবান ও তারকা শ্রেণির মানুষদের ঘিরে। প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি মিলেই ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী করে তুলছে।
সিলিকন ভ্যালি ও এআই যুদ্ধ
সবচেয়ে স্পষ্টভাবে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সিলিকন ভ্যালিতে, যেখানে বড় উদ্যোক্তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) বাজি ধরছেন। মধ্যপর্যায়ের ব্যবস্থাপকরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছেন, আর তারকা গবেষকরা বাজার দখল করছেন। ধারণা হলো, সেরা ১০০ জন গবেষকের মূল্য গুণিতক হারে বেড়ে যায় পরের দলের তুলনায়। মার্ক জাকারবার্গ কয়েকশো মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিচ্ছেন প্রতিভাবান প্রোগ্রামারদের, ওপেনএআইকে ধরতে। স্যাম অল্টম্যান মনে করেন, মাত্র একমুঠো মানুষই এআই–এর বড় অগ্রগতি আনবে। এলন মাস্ক একে বলেছেন, “সবচেয়ে পাগলাটে প্রতিভা যুদ্ধ।”

হেজ ফান্ড, আইন ও শোবিজে তারকা শিকার
হেজ ফান্ডগুলো এখন তারকা পোর্টফোলিও ম্যানেজারদের পেছনে অস্থিরভাবে ছুটছে। বিনিয়োগ ব্যাংকের ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো, যেখানে ব্যাঙ্কাররা বেশি মুনাফা ভাগ পান, তাদের অংশ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আইনশাস্ত্রেও শীর্ষ পার্টনাররা বাকিদের থেকে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। একসময়ের ‘সমান বেতন’ প্রথা এখন ভেঙে পড়েছে।
শোবিজনেসে বড় তারকারা আরও বড় হচ্ছেন। ২০১৭ সাল থেকে স্পটিফাইতে ১ কোটি ডলারের বেশি আয়ের শিল্পীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। সেলিব্রিটিরা নিজেদের ব্র্যান্ড চালু করছেন, যেমন কিম কার্দাশিয়ান ও হেইলি বিবার। লেখকেরাও সংবাদপত্রের সমষ্টিগত প্রয়াস ছেড়ে সাবস্ট্যাকে চলে যাচ্ছেন, যার বাজারমূল্য যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফের দ্বিগুণ।
তারকাখ্যাতির পুরনো ও নতুন যুক্তি
তারকাখ্যাতির অর্থনীতি নতুন কিছু নয়। ১৮৯০ সালে অর্থনীতিবিদ অ্যালফ্রেড মার্শাল দেখিয়েছিলেন, প্রতিভা ও সৌভাগ্যে ব্যতিক্রমী ব্যক্তির আয় কেন সাধারণদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। মহান পিয়ানোবাদকের সুর দুইজন ভালো শিল্পীর চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ দেয়—এই যুক্তিই মূল। ১৯৮১ সালে শারউইন রোজেন দেখান, সামান্য বেশি দক্ষ সার্জনও প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক বেশি পারিশ্রমিক পেতে পারে। গণযোগাযোগ যত সহজ হয়, প্রতিভার মুল্য তত বহুগুণে বাড়ে।
এআই গবেষক ও প্রতিযোগিতা
প্রযুক্তি ও অর্থনীতির দ্রুত অগ্রগতি তারকাখ্যাতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এআই–এর দৌড়ে কোম্পানিগুলো শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। তাই তারা সেরা গবেষকদের দলে টানতে সব করছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ‘নন-কমপিট’ চুক্তি কার্যকর নয়, ফলে গবেষকরা সহজেই চাকরি বদল করতে পারছেন। গুগল, মাইক্রোসফট ও মেটা তারকা গবেষকদের টানতে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।
অন্যদিকে, গুগল ও মাইক্রোসফট ছাঁটাই করেছে বিশেষত মধ্যপর্যায়ের ম্যানেজারদের, যা ব্যবসায় শিক্ষালয়ের জন্য খারাপ খবর। বড় কোম্পানিগুলো এখন ‘মেকার বনাম ম্যানেজার’ অনুপাত বাড়ানোর কৌশল নিচ্ছে।

ওয়াল স্ট্রিট ও হেজ ফান্ডের তারকা
ওয়াল স্ট্রিটে কম সংখ্যক মেধাবী কর্মী এখন বিশাল মুনাফা করছে। জেন স্ট্রিট মাত্র ৩ হাজার কর্মী নিয়ে ৬.৯ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে, যেখানে গোল্ডম্যান স্যাকসের ৪৬ হাজার কর্মী ৩.৭ বিলিয়ন ডলার অর্জন করেছে। হেজ ফান্ড সিটাডেল ও মিলেনিয়ামে প্রতিভা যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
হেজ ফান্ড ও এআই ল্যাব প্রায় একই ধরনের গণিত বিশেষজ্ঞ খুঁজছে। তবে হেজ ফান্ড বাজারটি আরও গোপনীয় এবং কঠিন। অনেকসময় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ও আইনি লড়াই দেখা দিচ্ছে, যেমন জেন স্ট্রিট ও মিলেনিয়ামের মামলা।
প্রযুক্তি ও বিনোদনে স্বাধীন তারকা
যোগাযোগ প্রযুক্তি এখন ব্যক্তিদের আরও বেশি সুযোগ দিচ্ছে স্বাধীনভাবে কাজ করার। লেখকেরা সাবস্ট্যাকে, মডেলরা অনলি-ফ্যানসে চলে যাচ্ছেন। সিলিকন ভ্যালিতেও তরুণ উদ্যোক্তারা নিজস্ব কোডিং স্টাইল দিয়ে বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখছেন।
নায়ক পূজা ও নতুন সংস্কৃতি
সামাজিকভাবে সচেতন পুঁজিবাদ এখন পিছনে পড়ে গেছে। সিলিকন ভ্যালিতে জেমস বার্নহামের ১৯৪১ সালের বই “দ্য ম্যানেজেরিয়াল রেভল্যুশন” আবার জনপ্রিয় হয়েছে। সাধারণ মানুষও ব্যক্তিকেই পূজা করছে। আগের প্রজন্ম আয়েন র্যান্ড পড়ত, এখন টিকটকে ফিটনেস তারকা অ্যাশটন হল দেখে।
শীর্ষ নির্বাহীরাও এখন সেলিব্রিটিতে পরিণত হচ্ছেন। অনেক সিইও এখন পডকাস্টে নিজের বার্তা দেন। খুচরা বিনিয়োগকারীরাও স্টক মার্কেটকে এক ধরনের গেমশোতে পরিণত করেছে। এলন মাস্ক এ প্রবণতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
![]()
সম্ভাব্য ঝুঁকি
অনেকে মনে করেন, ব্যক্তিনির্ভর এই অতিরিক্ত মনোযোগ এক ধরনের বাজার বুদবুদের ইঙ্গিত। বড় কোম্পানিগুলো হয়তো অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করছে। তবে কাঠামোগতভাবে সুপারস্টার যুগ এখন স্থায়ী হয়ে গেছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















