নির্বাচনী লড়াইয়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা
আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কলম্বিয়া নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। ডানপন্থী প্রার্থী ভিকি দাভিলা সতর্ক করেছেন যে দেশটি এখন “নরকের দ্বারপ্রান্তে” দাঁড়িয়ে আছে। তার মতে, এবার সিদ্ধান্ত হবে কলম্বিয়া ‘জ্বলবে’ নাকি ‘ফিরে আসবে’। অন্যদিকে বামপন্থী প্রার্থী ও প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রোর ঘনিষ্ঠ গুস্তাভো বলিভার দাবি করেন, গত ছয় মাস কলম্বিয়ার অর্থনীতির জন্য দুর্দান্ত গেছে। তার ভাষায়, শেয়ারবাজার ও পর্যটন খাত উন্নত হয়েছে, বেকারত্ব রেকর্ড পরিমাণে কমেছে, আর মুদ্রাস্ফীতি স্পষ্টভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বাস্তব অবস্থা: ভালো হলেও ঝুঁকি রয়ে গেছে
কলম্বিয়ার অর্থনীতি বর্তমানে মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে। চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হবে ২.৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের চেয়ে ভালো। জুলাইয়ে বেকারত্ব হার ছিল ৮.৮ শতাংশ — প্রায় ২৫ বছরে সবচেয়ে কম। শেয়ারবাজার স্থানীয় মুদ্রায় গত এক বছরে ৫৪ শতাংশ বেড়েছে, যা বিশ্বে চতুর্থ সেরা প্রদর্শন। ২০২৪ সালে পর্যটক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ লাখে, দুই বছরে যা বেড়েছে ২০ লাখ।
তবে অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। দেশের ৬০ শতাংশ শ্রমিক এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই এবং উৎপাদনশীলতাও কম। বিনিয়োগের অভাব টেকসই প্রবৃদ্ধিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নতুন তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে নিষেধাজ্ঞা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে।
দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে সীমিত অগ্রগতি
সরকার দারিদ্র্য হ্রাসে কিছুটা সফল হলেও চরম দারিদ্র্যের হার প্রায় অপরিবর্তিত। অসমতা ধীরে ধীরে কমলেও কলম্বিয়া এখনো বিশ্বের অন্যতম বৈষম্যপূর্ণ দেশ। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর ফলে আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি দেওয়া ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে, যার কারণে আরও বেশি মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রের বাড়তি ভূমিকা বরং সমস্যা তৈরি করেছে — মাতৃত্বকালীন ও জরুরি সেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা রোগী ভর্তি নিতে অস্বীকার করছে।
বাজেট ঘাটতির চাপ
সরকারি ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি চলতি বছরে জিডিপির ৭ শতাংশে পৌঁছাবে এবং ঋণ সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে ৬০ শতাংশের ওপরে যাবে। সরকার ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়াই ব্যয় ও ঋণের আইনি সীমা স্থগিত করেছে, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। ফলে পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে কঠিন আর্থিক সংকট সামলাতে হবে।
নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় নিরাপত্তা। জুনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিগুয়েল উরিবে খুন হন। সেপ্টেম্বরে কালি শহরে ট্রাক বোমা হামলা, একটি পুলিশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়া ও নানা সহিংস ঘটনায় ২০ জন নিহত এবং ৭০ জনের বেশি আহত হন। সামরিক বাহিনীর উপর আক্রমণ বাড়ছে, জিম্মি ও মুক্তিপণের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।
প্রেসিডেন্ট পেত্রোর “পাজ টোটাল” বা সর্বমোট শান্তি পরিকল্পনা কার্যত ভেস্তে গেছে। বিদ্রোহী নাম ব্যবহার করলেও এসব গোষ্ঠী মূলত মাদক ব্যবসায়ী। তারা যুদ্ধবিরতির সুযোগে নতুন এলাকা দখল, অস্ত্র সংগ্রহ ও সদস্য নিয়োগ করছে। বর্তমানে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার — পেত্রো ক্ষমতায় আসার পর যা ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আরও ২ লাখ ৩০ হাজার।
অপরাধের উত্থান
২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চাঁদাবাজি ৫০ শতাংশ বেড়েছে, অপহরণ বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। হত্যা হার এখন প্রতি লাখে ২৫ জন, যা অঞ্চলের অন্য গণতান্ত্রিক দেশের চেয়ে বেশি। যদিও ১৯৯০-এর দশকের ভয়াবহ সময়ের তুলনায় এখন কম। তখন পাবলো এস্কোবারের সন্ত্রাসে এই হার ছিল প্রতি লাখে ৮৬।
প্রতিষ্ঠান নিয়ে সংঘাত
প্রেসিডেন্ট পেত্রো প্রায়ই দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে “প্রাতিষ্ঠানিক অবরোধ” চলছে। তিনি সংবিধান নতুন করে লেখার জন্য গণভোটের হুমকি দেন। সংসদ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আদালতের সঙ্গে নিয়মিত তার সংঘাত হচ্ছে। মন্ত্রিসভায় টিকে থাকার সময় গড়ে মাত্র ২০ দিন — এত দ্রুত পরিবর্তনে প্রশাসন দুর্বল ও দিকহারা হয়ে পড়ছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
কলম্বিয়ার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতায় পেত্রো এক মেয়াদেই সীমাবদ্ধ থাকবেন। তবে তার অস্থির নীতির কারণে সাধারণ মানুষ দেশ ছাড়ছে — গত তিন বছরে প্রায় ১০ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে গেছে।
কলম্বিয়া এখনো নরকের দরজায় দাঁড়ায়নি। কিন্তু দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা দুই ক্ষেত্রেই কঠিন লড়াই করতে হবে, যাতে কলম্বিয়াকে আবার স্থিতিশীল পথে ফিরিয়ে আনা যায়।