২৫ আগস্ট ইসরায়েলি সেনারা গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে গোলাবর্ষণ করে। এতে ২২ জন নিহত হন, যার মধ্যে পাঁচজন ছিলেন সাংবাদিক। ইসরায়েল দাবি করেছিল, তারা হামলা চালিয়েছে একটি হামাস ক্যামেরা ধ্বংস করতে।
কিন্তু রয়টার্সের তদন্তে স্পষ্ট হয়, ক্যামেরাটি আসলে তাদেরই সাংবাদিক হুসাম আল-মাসরির ছিল। মাসরি নিয়মিত হাসপাতালে ক্যামেরা বসিয়ে সরাসরি সম্প্রচার করতেন এবং ধুলো-গরম থেকে বাঁচাতে সবুজ-সাদা জায়নামাজ দিয়ে ঢাকতেন।
ভুল অনুমান ও কমান্ড ভাঙা
ইসরায়েলি সেনারা ওই ক্যামেরাকে সন্দেহজনক ভেবে ধ্বংস করে। পরে জানা যায়, হামলার জন্য সংশ্লিষ্ট বাহিনী শীর্ষ কমান্ডারের অনুমতি নেয়নি। এতে সামরিক নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে।
সাংবাদিকদের লক্ষ্য নয় দাবি
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই ঘটনাকে বলেন “দুঃখজনক দুর্ঘটনা”। সামরিক কর্মকর্তারা দাবি করেন, সাংবাদিকরা টার্গেট ছিলেন না। তবে হামাস প্রশাসনের মিডিয়া দফতর একে আখ্যা দিয়েছে “পূর্ণমাত্রার যুদ্ধাপরাধ”।
একাধিক প্রশ্নের উত্তর নেই
এক মাস পরও ব্যাখ্যা মেলেনি—
- কেন হাসপাতাল বা রয়টার্সকে সতর্ক করা হয়নি।
- কেন প্রথম আঘাতের নয় মিনিট পর আবার গোলাবর্ষণ হলো।
- কেন এমন স্থানে আঘাত করা হলো যা সাংবাদিকরা প্রতিদিন ব্যবহার করতেন।
- এবং কে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছিল।
সাংবাদিকদের প্রাণহানি
হামলায় রয়টার্সের মাসরি, এপি-র মারিয়াম দাগ্গাসহ একাধিক সাংবাদিক নিহত হন। তাঁরা নিয়মিত ওই সিঁড়ি ব্যবহার করতেন কারণ সেখান থেকে বিস্তৃত এলাকা দেখা যেত এবং সরাসরি সম্প্রচারের সুবিধা পাওয়া যেত।
সাংবাদিক হত্যার দীর্ঘ তালিকায় এই ঘটনাও যোগ হলো। অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২০১ জন সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। তাদের মধ্যে ১৯৩ জনই ফিলিস্তিনি।
পূর্বের ঘটনার প্রতিধ্বনি
ইসরায়েল অতীতে সাংবাদিক হত্যার ঘটনায়ও দায় স্বীকার বা পূর্ণ তদন্ত প্রকাশ করেনি। ২০২২ সালে আল জাজিরার শিরিন আবু আকলেহ এবং ২০২৩ সালে লেবাননে রয়টার্সের ইসাম আবদাল্লাহ নিহত হলেও তদন্তের ফল প্রকাশ হয়নি।
হাসপাতালকে লক্ষ্যবস্তু করা
আন্তর্জাতিক আইনে হাসপাতাল লক্ষ্য করা যুদ্ধাপরাধ। কেবল তখনই ব্যতিক্রম হয় যখন তা শত্রুর সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। তবুও হামলার আগে সতর্কবার্তা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু নাসের হাসপাতালে এমন কোনো সতর্কবার্তা আসেনি।
ট্যাঙ্ক শেল ব্যবহারের সমালোচনা
হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষে প্রমাণ মেলে ইসরায়েলি সেনারা ১২০ মিলিমিটার ট্যাঙ্ক শেল ব্যবহার করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি ক্যামেরা ধ্বংস করতে হাসপাতালের ভেতরে এমন ভারী অস্ত্র ব্যবহার অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত প্রাণহানির কারণ।
দ্বিতীয় দফা হামলা
প্রথম আঘাতের পর সাংবাদিক ও উদ্ধারকর্মীরা মাসরির মরদেহ নামিয়ে আনছিলেন। তখনই দ্বিতীয় দফা হামলা হয়, যাতে আরও অনেকে নিহত ও আহত হন। রয়টার্সের আলোকচিত্রী হাতেম খালেদ আহত হন এবং তাঁর কানে স্থায়ী ক্ষতি হয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও দায়মুক্তি
সিপিজে বলছে, এত সাংবাদিক নিহত হলেও ইসরায়েল কখনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রকাশ করেনি বা কাউকে দায়ী করেনি। আন্তর্জাতিক নিন্দাও ইসরায়েলের আচরণ বদলায়নি।
নাসের হাসপাতালের এই হামলা শুধু সাংবাদিক হত্যার ধারাবাহিকতাকেই দীর্ঘ করেনি, বরং প্রমাণ করেছে—যে ক্যামেরাকে “হামাসের” বলে দাবি করা হয়েছিল, তা আসলে নিহত সাংবাদিকের পেশাগত কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র। সেনারা অনুমতি ছাড়াই হামলা চালায়, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক দায়বদ্ধতার গুরুতর লঙ্ঘন।