আলোচনায় নতুন জটিলতা
সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিনের আলোচনায় শেষ মুহূর্তে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। চারটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ইসরায়েল দক্ষিণ সিরিয়ার সুইদা প্রদেশে একটি “মানবিক করিডোর” খোলার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেছে। এই দাবি আগেই সিরিয়া প্রত্যাখ্যান করেছিল, কিন্তু আবারও আলোচনায় তোলায় সমঝোতার সম্ভাবনা থেমে গেছে।
নিরাপত্তা চুক্তির লক্ষ্য
মার্কিন মধ্যস্থতায় গত কয়েক মাসে বাকু, প্যারিস ও লন্ডনে সিরিয়া-ইসরায়েল বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগেই এ আলোচনা ত্বরান্বিত হয়। সম্ভাব্য চুক্তির মাধ্যমে সুইদাসহ কিছু এলাকায় একটি নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। সেখানে জুলাই মাসে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল, বিশেষ করে দ্রুজ সম্প্রদায়ের লোকজন।
ইসরায়েলের অবস্থান
ইসরায়েলে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার দ্রুজ বসবাস করে, যাদের পুরুষরা দেশটির সেনাবাহিনীতে সেবা করে। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা সিরিয়ার দ্রুজ জনগোষ্ঠীকে রক্ষার দায়িত্ব নেবে এবং সে কারণে সিরিয়ায় কয়েকবার সামরিক অভিযানও চালিয়েছে, প্যারিস বৈঠকে ইসরায়েল প্রথমে সুইদায় একটি স্থল করিডোর খুলে সাহায্য পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। সিরিয়া এটিকে সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে নাকচ করে। শেষ মুহূর্তে এই একই দাবি আবার তোলায় আলোচনার পথ আটকে গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও সীমিত অগ্রগতি
মার্কিন দূত টম ব্যারাক জানিয়েছেন, মূল নিরাপত্তা চুক্তির পরিবর্তে এখন আলোচনা “ডি-এস্কেলেশন চুক্তি”র দিকে যাচ্ছে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরায়েল আক্রমণ বন্ধ রাখবে এবং সিরিয়া সীমান্তের কাছে ভারী সামরিক সরঞ্জাম সরাবে না। এক কূটনীতিক বলেন, “নিরাপত্তা চুক্তি” থেকে সরে গিয়ে এখন “সংঘাত প্রশমন চুক্তি”র দিকে এগোচ্ছে আলোচনা।
সিরিয়ার সন্দেহ ও আশঙ্কা
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আগে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ইসরায়েল হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে সময়ক্ষেপণ করছে। তিনি বলেন, “আমরা ইসরায়েলকে ভয় পাই। আমরা উদ্বিগ্ন। উল্টোটা নয়।” এক সিরীয় কর্মকর্তা জানান, জাতিসংঘ অধিবেশনের আগে আলোচনা ইতিবাচক ছিল, কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে আর কোনো কথা হয়নি।
নেতানিয়াহুর বক্তব্য
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন সিরিয়ার সঙ্গে এমন একটি চুক্তি হতে পারে যা সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে এবং একই সঙ্গে ইসরায়েল ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবে। এ বিষয়ে নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, আলোচনার যেকোনো চূড়ান্ত ফল ইসরায়েলের স্বার্থ নিশ্চিতের ওপর নির্ভর করছে। এর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়া নিরস্ত্রীকরণ ও দ্রুজ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অন্যতম।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান পরিস্থিতি
ইসরায়েল ও সিরিয়া ১৯৪৮ সাল থেকে পরস্পরের শত্রু। ১৯৭৪ সালে একটি বিচ্ছিন্নতা চুক্তির মাধ্যমে সীমান্তে জাতিসংঘ-নিয়ন্ত্রিত একটি নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল গড়ে ওঠে। কিন্তু গত বছর ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ইসরায়েল দেশজুড়ে সিরীয় সামরিক স্থাপনায় হামলা বাড়িয়ে দেয় এবং দক্ষিণাঞ্চলে সেনা পাঠায়। ইসরায়েল প্রকাশ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট শারাকে শত্রু মনে করছে এবং তার আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট অতীতের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে সিরিয়াকে দুর্বল রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
সম্ভাব্য সমঝোতার ভবিষ্যৎ
সিরিয়া বারবার ১৯৭৪ সালের চুক্তিতে ফেরার প্রস্তাব দিয়েছে। সেপ্টেম্বরে শারা সাংবাদিকদের বলেন, চুক্তি হওয়া “অপরিহার্য”। তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ইসরায়েল কি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে? তার মতে, যেকোনো মুহূর্তে সমঝোতা হতে পারে, আবার নতুন সমস্যা দেখা দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
মানবিক করিডোর নিয়ে ইসরায়েলের দাবি পুনরায় আলোচনার অগ্রগতি থামিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি প্রশমন চুক্তির দিকে মোড় ঘোরাচ্ছে, তবে ইসরায়েল-সিরিয়া আস্থার সংকট এখনো গভীর।