শুকিয়ে যাওয়া আতাকামার জলাভূমি
চিলির আতাকামা মরুভূমির লবণক্ষেত্রের ভেগা দে তিলোপোজো (Vega de Tilopozo) অঞ্চলে হাঁটতে গিয়ে রাকুয়েল সেলিনা রদ্রিগেজ দেখান—যেখানে একসময় পানিভর্তি ঝর্ণাধারা ছিল, এখন সেখানে ফাটলধরা শুকনো জমি।
তিনি বলেন, “আগে পুরো ভেগা সবুজে ঢাকা থাকত। এখন সব শুকিয়ে গেছে।”
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার পরিবার এখানে ভেড়া চরাতো। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় ঘাস কমে যায়। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন খনন কোম্পানিগুলো ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে শুরু করল।
লিথিয়ামের চাহিদা ও ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃতি
আতাকামার নিচে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিথিয়াম মজুত। বৈদ্যুতিক গাড়ি, ল্যাপটপ ও সৌরশক্তি সঞ্চয়ে ব্যবহৃত ব্যাটারির জন্য এই ধাতুর চাহিদা দ্রুত বেড়েছে।
২০২১ সালে বিশ্বে ৯৫-হাজার টন লিথিয়াম ব্যবহার হয়েছিল। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৫ হাজার টন। অনুমান করা হচ্ছে ২০৪০ সালে তা ৯ লক্ষ টনেরও বেশি হবে।
কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ—এই বাড়তি খনন তাদের পরিবেশকেই ধ্বংস করছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে নেওয়া পদক্ষেপ কি নতুন সংকট তৈরি করছে?
হ্রদ, ফ্লেমিঙ্গো ও হারিয়ে যাওয়া পানির গল্প
চিলি বিশ্বে অস্ট্রেলিয়ার পর দ্বিতীয় বৃহত্তম লিথিয়াম উৎপাদক। সরকার জাতীয় লিথিয়াম কৌশল ঘোষণা করেছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি কোডেলকোকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসকিউএমের সঙ্গে যৌথভাবে উৎপাদন বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর ভূগর্ভস্থ পানি বের করা হয়—যেখানে পানি সংকট আগেই তীব্র।
স্থানীয় জীববিজ্ঞানী ফাবিওলা গনসালেস জানান, লস ফ্লেমিঙ্গোস জাতীয় উদ্যানে হ্রদগুলো সঙ্কুচিত হয়েছে, ফ্লেমিঙ্গো প্রজনন কমেছে। কারণ খননকৃত পানি কমে যাওয়ায় জীবাণু ও খাদ্যশৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, আতাকামার লবণক্ষেত্র প্রতি বছর ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার করে বসে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (OECD) প্রতিবেদনে বলা হয়, লিথিয়াম খনন জলসম্পদে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করছে।
প্রকৃতি ও সমাজের ক্ষয়
এসকিউএমের খনন এলাকায় ২০১৩ সালেই স্থানীয় আলগারোবো গাছের এক-তৃতীয়াংশ শুকিয়ে যেতে শুরু করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনআরডিসি রিপোর্টে বলা হয়, এই খনন পরিবেশকে “শোষণের সীমায়” নিয়ে যাচ্ছে।
জার্মানির অধ্যাপক কারেন স্টেগেন বলেন, কোনো খননই প্রকৃতির জন্য নিরীহ নয়। তবে শুরু থেকেই স্থানীয় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে ক্ষতি কিছুটা কমানো যেত।
কোম্পানির দাবি বনাম স্থানীয়দের শঙ্কা
এসকিউএম জানায়, তারা নতুন প্রযুক্তি আনছে যাতে বাষ্পীভবন পদ্ধতি বাদ দিয়ে সরাসরি লিথিয়াম উত্তোলন করা যায় এবং বাষ্পীভূত পানি পুনরায় জমিতে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। তারা দাবি করছে, ২০৩১ সালেই এই পরিবর্তন শুরু হবে।
কিন্তু স্থানীয়রা সন্দিহান। তাদের আশঙ্কা, আতাকামাকে একটি “প্রাকৃতিক পরীক্ষাগার” বানানো হচ্ছে। রাকুয়েল ও সারা প্লাজা বলেন, “খনন একদিন শেষ হবে, কিন্তু পানি ও প্রকৃতি হারালে আমাদের বাঁচার উপায় কী থাকবে?”
পানির অভাব ও জীবনের সংকট
পেইনে সম্প্রদায়ের নেতা সার্জিও কুবিওস বলেন, পানির সংকটে তাদের পানীয় জল, বিদ্যুৎ, শোধনাগার—সব কিছু বদলাতে হয়েছে। তিনি মনে করেন, মূল ক্ষতি করেছে খনন শিল্প, আর সিদ্ধান্ত হচ্ছে রাজধানী সান্তিয়াগোতে বসে, স্থানীয়দের মতামত ছাড়া।
তিনি সতর্ক করেন, যদি নতুন প্রযুক্তি ব্যর্থ হয় এবং ক্ষতি আরও বাড়ায়, তবে তারা আন্দোলন করে খনন বন্ধ করবেন।
বৈশ্বিক দোটানা
আতাকামার পরিস্থিতি আসলে বৈশ্বিক দ্বিধার প্রতিচ্ছবি মাত্র। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে নবায়নযোগ্য শক্তি দরকার, কিন্তু তার জন্য খনন আবার পরিবেশ ধ্বংস করছে।
কিছু বিশ্লেষক বলেন, স্থানীয়রা আসলে অর্থ চায়। কিন্তু অধ্যাপক স্টেগেনের মতে, অর্থ বা চাকরি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মূল দাবি নয়। তারা চায় তাদের প্রথাগত জীবনধারা ও প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ থাকুক।
উন্নয়ন বনাম টিকে থাকা
স্থানীয়দের বক্তব্য—তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার বিরুদ্ধে নন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তাদেরই মূল্য দিতে হচ্ছে?
ফাবিওলা বলেন, “বৈদ্যুতিক গাড়ি ইউরোপ ও আমেরিকার জন্য, আমাদের জন্য নয়। অথচ আমাদের পানি আর পবিত্র পাখি হারিয়ে যাচ্ছে।”