বন্যার কবলে সীমান্তের গ্রাম
সীমান্তবর্তী গ্রামীণ এলাকার মানুষ জীবিকার জন্য গবাদি পশুর ওপর নির্ভরশীল। তাই ঘরবাড়ি ছাড়লেও তারা পশু ফেলে যেতে রাজি নন।
ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা তালওয়ার পোস্টের কাছে রেঞ্জার্স পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রে পৌঁছান জাভেদ আলী নামে চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। তার সঙ্গে স্ত্রী, ছোট মেয়ে ও পরিবারের আরও সদস্যরা। তারা সবাই নৌকায় ভেসে এসেছেন, আশায় কিছু ত্রাণসামগ্রী মিলবে।
জাভেদ বলেন, “আমাদের গ্রামে বন্যা আঘাত হানে প্রায় ১০ দিন আগে। তবে তিন দিন আগে পর্যন্ত ঘরে পানি ঢোকেনি।বৃহস্পতিবার ঘর ঘিরে ফেলে পানি। চারদিকে জলাবদ্ধতায় আমরা বের হতে পারিনি। তিন দিন ধরে ফোন করছিলাম, কিন্তু সাহায্য পেতে দেরি হলো।”
তার ছোট মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত, বন্যার পানিতে থাকার কারণে চামড়ায় সংক্রমণ হয়েছে। স্ত্রী ও ভাতিজিরও একই সমস্যা। তাই তারা দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে ওষুধ নেন।
কোথায় যাবে পরিবার?
জাভেদ জানান, তারা ফারুক এলাকায় আত্মীয়দের কাছে যেতে চান, কিন্তু কিভাবে কাসুরে পৌঁছাবেন, তা জানেন না। উদ্ধারকর্মীরা শুধু মানুষকে পানিবন্দি এলাকা থেকে সরিয়ে আনতে পারছেন, কিন্তু আরও পরিবহনের নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না।
তাদের মতো অসংখ্য পরিবারকে উদ্ধার করে তালওয়ার পোস্টের শিবিরে আনা হয়েছে। চোখের সামনে সীমান্তের ওপারে ভারত, আর চারপাশ জলে ভরা বিশাল এলাকা। এই ক্যাম্প এখন ১৬টি গ্রামের আশ্রয়স্থল, যা একসময় পাকিস্তানের শেষ গ্রাম ছিল।
সুযোগ-সুবিধাহীন আশ্রয়
রাজিওয়ালা এলাকায় বন্যার পানি এসে পড়েছে। এখানে শত শত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ গবাদি পশুসহ আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সেতলুজ নদীর প্লাবনে ঘরবাড়ি দীর্ঘদিন ধরে পানির নিচে ডুবে আছে। উদ্ধার নৌকা এখনও ব্যস্ত মানুষজনকে সরাতে।
তালওয়ার পোস্টের পাশে মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। অনেকেই চিকিৎসা শেষে আত্মীয়দের কাছে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন।
পশুই জীবিকার মূল ভরসা
২০ বছর বয়সী সালমান তার ৫০টি ভেড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জানান, ১১ দিন আগে নড়বড়ে নৌকায় প্রাণ বাঁচাতে পশু নিয়ে এসেছিলেন। গরু ও বড় প্রাণীগুলোকে আগে পাঠানো হয়েছে খাবারের খোঁজে। তিনি বলেন, “বাড়িঘর কিছুই নেই, শুধু পশুই ভরসা। তবে খাবার নেই, নিজেরাই সব জোগাড় করছি।”
তার গ্রামের ১৫০টি ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। কর্তৃপক্ষ কাউকে ফিরতে দিচ্ছে না। ফলে মানুষজন ভীষণ উদ্বিগ্ন।
ভিখিওয়িন্দ গ্রামের করুণ চিত্র
মুস্তাক ও শাহিদ জানান, তাদের ভিখিওয়িন্দ গ্রাম পুরোপুরি ডুবে গেছে। আগে কখনো এত পানি আসেনি। এ বছর পানির তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ২৫টি পরিবারকেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রথমে একজন করে পুরুষ বাড়ি পাহারা দিতে থাকলেও পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরও সরিয়ে দেয়।
তাদের অভিযোগ, সরকার কোনো সাহায্য দিচ্ছে না: না মানুষের জন্য খাবার, না পশুর জন্য খাদ্য। শুধু আল-খায়ের ও আল-খিদমত ফাউন্ডেশন কিছু খাবার দিয়েছে। তবে ত্রাণশিবিরে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অনেক অপ্রভাবিত গ্রামের মানুষও ত্রাণ চাইতে আসে, তাই যাচাই করতে হয়।
স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্ধার
মুহাম্মদ ফারুক স্থানীয়ভাবে তৈরি ভেলায় মানুষ ও গবাদি পশু পার করছেন। তিনি উপজেলা কমিশনারের অফিস থেকে ডিজেল পান, যা দিয়ে নৌকা চালান।
চঙ্গা সিং ও ধুপসারি গ্রামের মানুষদের তিনি শিবিরে আনছেন। আসিফ নামে এক বাসিন্দা নিজের গ্রাম থেকে গমের মজুদ বাঁচাতে চেষ্টা করলেও বৃষ্টি আবার সব নষ্ট হওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর মানুষের প্রধান দুশ্চিন্তা শুধু ঘরবাড়ি নয়, বরং তাদের জীবিকার একমাত্র ভরসা—গবাদি পশুই তাদের একমাত্র ভরসা। বন্যা তাদের জীবন ও জীবিকা দুটোই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে তারা এখন বেসরকারি সাহায্যের অপেক্ষায়।