পুলিশের অভিযান ও সাংবাদিক নির্যাতন
২ অক্টোবর ইসলামাবাদ পুলিশের একটি দল ন্যাশনাল প্রেসক্লাব (এনপিসি)-এ অভিযান চালায়। এসময় বহু সাংবাদিককে লাঠিচার্জ ও মারধর করা হয়। টেলিভিশন ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের সদস্যরা সাংবাদিকদের ক্যাফেটেরিয়া থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করছে। এক সাংবাদিককে ভাঙা ক্যামেরা ও ছেঁড়া জামা হাতে দেখা যায়।
ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি এ ঘটনাকে “দুঃখজনক” বলে উল্লেখ করে তদন্তের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাংবাদিক সংগঠনের ক্ষোভ ও অবস্থান
পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস (পিএফইউজে) সভাপতি আফজাল বাট জানান, প্রেসক্লাব কর্মকর্তারা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলে তারাও পুলিশের হাতে মারধরের শিকার হন। দুইজনকে আটক করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বাট বলেন, “এটি সাংবাদিক সমাজের জন্য একটি ‘এখন না হলে আর কখনো নয়’ ধরনের পরিস্থিতি।” তিনি জরুরি বৈঠক ডাকার ঘোষণা দেন, যেখানে সরকারের কাছে দাবিসমূহ তুলে ধরা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, “প্রেসক্লাব হলো সাংবাদিকদের ঘর। এখানে ঢুকে সাংবাদিককে মারধর, ক্যামেরা ও মোবাইল ভাঙচুর—এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।”
সরকারের প্রতিক্রিয়া
রাষ্ট্রীয় মন্ত্রী তালাল চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ঘটনাকে “হঠাৎ ঘটে যাওয়া” বলে দাবি করেন। তার দপ্তর থেকে জানানো হয়, কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশের ওপর হামলা করলে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয় এবং সেই সূত্রে পুলিশ প্রেসক্লাবে প্রবেশ করে।
তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার এ ঘটনাকে “দুঃখজনক” উল্লেখ করে জানান, ব্যাপক তদন্ত হবে। তিনি বলেন, “ন্যাশনাল প্রেসক্লাব আমারও ঘর, আমি সাংবাদিকদের পাশে আছি।”
সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান
পরে রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদ ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের সভাপতি তারিক ভিরক বলেন, “পুলিশ নিজেরা আসেনি, তাদের পাঠানো হয়েছিল। তারা শুধু সাংবাদিকদের নয়, প্রেসক্লাবের অসুস্থ এক কর্মীকেও নির্যাতন করেছে।”
পিএফইউজে সভাপতি বাট এটিকে পাকিস্তানের ইতিহাসের এক “অন্ধকার দিন” বলে আখ্যা দেন। তিনি ঘোষণা দেন, দেশব্যাপী কালো পতাকা উত্তোলন ও ‘কালো দিবস’ পালন করা হবে।
সাংবাদিকদের বয়ান ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
জিও নিউজের সাংবাদিক ও প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক শিরাজ গারদেজি জানান, আজাদ কাশ্মীর যৌথ আওয়ামি অ্যাকশন কমিটির কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ প্রেসক্লাব ঘিরে ধরে। সাংবাদিকদের কভারেজে বাধা দেওয়া হয়, ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। পরে পুলিশ প্রেসক্লাবের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ক্যাফেটেরিয়ায় ভাঙচুর করে এবং কয়েকজনকে মারধর করে।
সাংবাদিক সংগঠনের যৌথ বিবৃতি
পিএফইউজে, কাউন্সিল অব পাকিস্তান নিউজপেপার এডিটরস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এডিটর্স অ্যাসোসিয়েশন এক যৌথ বিবৃতিতে এ ঘটনাকে “সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড” আখ্যা দিয়েছে। তারা অবিলম্বে দায়ীদের শাস্তির দাবি জানায় এবং সরকারকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চলমান দমননীতির ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে বলে।
তাদের অভিযোগ, সরকারপন্থী বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনের কৌশল।
মানবাধিকার সংগঠন ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তান (এইচআরসিপি) ঘটনাটিকে নিন্দা জানিয়ে তদন্ত দাবি করে। সাংবাদিক হামিদ মির, তালাত হুসাইন, মতি উল্লাহ জানসহ অনেকে এটিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মানবাধিকারকর্মী তাহিরা আব্দুল্লাহ বলেন, শুধুই ক্ষমা নয়—দোষীদের গ্রেপ্তার, বিচার এবং প্রেসক্লাবের ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন।
অভিজ্ঞ সাংবাদিক মাজার আব্বাস এ ঘটনাকে জিয়া-উল-হক ও পারভেজ মুশাররফ আমলের দমননীতির কথা মনে করিয়ে দেয় বলে মন্তব্য করেন।
ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে পুলিশের এই অভিযান পাকিস্তানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। সাংবাদিক সংগঠনগুলো এটিকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা一 বলে আখ্যা দিয়েছে। দেশব্যাপী প্রতিবাদ, কালো পতাকা উত্তোলন এবং পরবর্তী কর্মসূচি সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে আরও জোরদার করছে।