হঠাৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত আফগানিস্তান
৪৮ ঘণ্টার জন্য আফগানিস্তানে ইন্টারনেট ও ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখে তালেবান সরকার। এতে লাখো মানুষ বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীদের মধ্যে। ব্যাংকিং সেবা বন্ধ হয়ে যায়, ব্যবসা ও ফ্লাইট স্থবির হয়ে পড়ে, বাজার অচল হয়ে পড়ে এবং সাহায্যকারী সংগঠনগুলো কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হারায়।
মানুষের হতাশা ও ভয়
কাবুলের এক সাংবাদিক হিউয়াদ ওয়াতান্দার জানান, মানুষ যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল। আশা পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও শঙ্কা প্রকাশ করে যে দেশটি হয়তো আবারও সংঘাতের মধ্যে ঢুকে পড়ছে।
তালেবানের যুক্তি ও সিদ্ধান্ত
দুই সপ্তাহ আগে তালেবান উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি প্রদেশে “অনৈতিক কার্যকলাপ রোধে” ইন্টারনেট বন্ধ করে। এবার কোনো সতর্কতা ছাড়াই পুরো দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়, যা তাদের সর্বোচ্চ নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা কন্দাহার থেকে নির্দেশ জারি করেন। তবে বন্ধ রাখার কারণ প্রকাশ করা হয়নি। দুই দিন পর হঠাৎ সংযোগ ফিরিয়ে আনা হয়।
অর্থনীতি ও দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব
অনলাইন লেনদেন ও ব্যবসা ভেঙে পড়ে। ব্যাংকের বাইরে লম্বা লাইন দেখা যায়। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা হার নির্ধারণ করতে পারেনি। অনেকে সীমান্তে গিয়ে পাকিস্তানের সিগন্যাল ধরার চেষ্টা করেছে। কৃষিপণ্যের রপ্তানিও ব্যাহত হয়। এক ব্যবসায়ী বলেন, তালেবান বুঝতে হবে, ইন্টারনেট আর বিলাসিতা নয়, এটি জীবনের অপরিহার্য অংশ।
নারীদের ওপর বাড়তি চাপ
নারীরা শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নিষিদ্ধ থাকায় ইন্টারনেটই তাদের একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছিল। শিক্ষা প্রকল্প ও রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। রেডিও বেগম জানায়, শুধু স্যাটেলাইট টিভিই তখন বাইরের বিশ্বের জানালা হয়ে ছিল।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জরুরি ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। জাতিসংঘের বিশেষ দূত রিচার্ড বেনেট সতর্ক করেন, এই ধরনের পদক্ষেপ ভঙ্গুর অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে এবং মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন ঘটাতে পারে।
সংযোগ ফিরে আসার আনন্দ ও ক্ষোভ
দুই দিন পর যখন ইন্টারনেট ফিরে আসে, মানুষ আনন্দে ভেসে যায়। অনেকে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কথা বলে স্বস্তি পান। তবে এর নিচে জমা হতে থাকে ক্ষোভ—এত সহজে একটি মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া যায় কেন? অনেকেই মনে করেন, তালেবান আবার ১৯৯০-এর দশকের নিষ্ঠুর শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
বিকল্প উপায় ও ঝুঁকি
কিছু মানুষ ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাইরের যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে। তবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে চালু নয় এবং ব্যবহারকারীদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “অনৈতিক বিষয়বস্তু” নিয়ন্ত্রণের জন্য এভাবে পুরো নেটওয়ার্ক বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব।
অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও মানসিক চাপ
বহিষ্কৃত সংসদ সদস্য মরিয়ম সোলাইমানখিল বলেন, এ সিদ্ধান্ত মানুষের মানসিক ভাঙন ঘটিয়েছে, অনেকে হতাশায় ডুবে গেছে। তালেবান দেশকে বাইরের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকাশ্য শাস্তি ও হত্যাকাণ্ডের মতো কাজ আড়ালে চালাতে চাইছে।
চূড়ান্ত বাস্তবতা
এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, ইন্টারনেটবিহীন জীবন এখন আর কল্পনা করা যায় না। তরুণ প্রজন্ম, এমনকি তালেবান সমর্থকরাও ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। তাই এটিকে কেবল একটি সুইচ বন্ধের মতো নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। তবে মানুষ আবারও আশঙ্কা করছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের অন্ধকার সময় যে কোনো মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে।