জাতীয় দিবসের আগে বিতর্কের ঝড়
চীনের জাতীয় দিবসকে সামনে রেখে দেশজুড়ে রেস্তোরাঁ শিল্পের ওপর বিশেষ দৃষ্টি পড়েছে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সময়েই শুরু হয়েছে প্রি-মেড বা আগে থেকে প্রস্তুতকৃত খাবার নিয়ে তীব্র বিতর্ক। বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে আসে ১০ সেপ্টেম্বর, যখন জনপ্রিয় উদ্যোক্তা ও প্রভাবশালী ব্লগার লুও ইয়ংহাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন যে, তিনি শি-বেই নামের একটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁ চেইনে নোংরা প্রি-মেড খাবার পেয়েছেন, অথচ সেটি বিক্রি হয়েছে প্রিমিয়াম দামে।
তিনি দাবি করেন, মেনুতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত কোন খাবার তাৎক্ষণিক রান্না এবং কোনটি প্রি-মেড। তার এই মন্তব্য লাখো মানুষের মধ্যে স্বচ্ছতা ও খাবারের মান নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে।
শি-বেই চেইনের পাল্টা বক্তব্য
শি-বেইয়ের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া গুওলং পাল্টা দাবি করেন যে, তাদের রেস্তোরাঁ কেবলমাত্র ‘আংশিক প্রক্রিয়াজাত’ খাবার পরিবেশন করে। তিনি এমনকি প্রমাণ হিসেবে ৪০০টিরও বেশি আউটলেটের রান্নাঘর খুলে দেন। কিন্তু এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন ভিডিও, যেখানে রেস্তোরাঁগুলোতে প্যাকেটজাত ও হিমায়িত খাবার ব্যবহার করতে দেখা যায়। এতে লুওর অভিযোগ আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
বিক্রির শঙ্কা ও ব্যবসায়িক প্রভাব
এই বিতর্কে অনলাইনে লাখো মানুষ যুক্ত হওয়ায় রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, বছরের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়গুলোর একটিতে বিক্রি মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত রেস্তোরাঁ শিল্পের আয় হয়েছে ৩.৬ ট্রিলিয়ন ইয়ুয়ান (৫০৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা গত বছরের তুলনায় মাত্র ৩.৬ শতাংশ বেশি। অথচ ২০২৪ সালে একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬ শতাংশ, আর ২০২৩ সালে ছিল ১৯.৪ শতাংশ।
‘সুপার গোল্ডেন উইক’ ও শঙ্কা
এ বছর জাতীয় দিবসের ছুটি মধ্য-শরৎ উৎসবের সঙ্গে মিলে আট দিনের ‘সুপার গোল্ডেন উইক’ তৈরি করেছে, যা রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের জন্য বড় সুযোগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রি-মেড খাবার নিয়ে চলমান বিতর্ক এই সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
প্রি-মেড খাবারের জনপ্রিয়তা ও ভোক্তার প্রতিক্রিয়া
যদিও বিতর্ক চলছে, তবুও প্রি-মেড খাবারের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। চায়না ফর্চুন সিকিউরিটিজের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে মাথাপিছু প্রি-মেড খাবারের খরচ ছিল ৫.৪ কেজি, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.১ কেজিতে। এ বছর এই বাজারের সম্ভাব্য মূল্য দাঁড়াবে ৪৭৫.৭ বিলিয়ন ইয়ুয়ান (৬৬.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
তবে সবাই এই প্রবণতা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। নিউ এক্সপ্রেস পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৭০ হাজার অংশগ্রহণকারীর এক-তৃতীয়াংশ কখনোই প্রি-মেড খাবার খাবেন না বলে জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশেরও বেশি দাবি করেছেন, খাবারে স্পষ্ট লেবেলিং থাকতে হবে।
নিয়ন্ত্রণ ও নীতি ঘাটতি
চীনে এখনও প্রি-মেড খাবারের জন্য কোনো জাতীয় মান নির্ধারিত হয়নি। ২০২৪ সালের মার্চে রাষ্ট্রীয় বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রশাসন এ ধরনের খাবারকে কৃষিজ পণ্য দিয়ে তৈরি, যা খাওয়ার আগে গরম বা রান্না করতে হয়, এমন প্রি-প্যাকেজড খাবার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তবে নিরাপত্তা বা লেবেলিংয়ের বাধ্যতামূলক নিয়ম এখনো তৈরি হয়নি।
২১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা কার্যালয় ঘোষণা করে যে, তারা দ্রুত মানদণ্ড ও লেবেলিং বিধি প্রণয়নের কাজ শুরু করবে। তবে কবে নাগাদ তা কার্যকর হবে সে বিষয়ে কোনো সময়সীমা জানানো হয়নি।
ব্যবসায়িক বাস্তবতা বনাম ভোক্তার প্রত্যাশা
গুয়াংডং প্রদেশের এক বিনিয়োগকারী উ ইয়ি বলেন, “চীনের অর্থনীতি ও পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তনের কারণে প্রি-মেড খাবারের ব্যবহার ক্রমেই বাড়বে। বড় চেইনগুলো খরচ কমাতে ও মান বজায় রাখতে এ ধরনের খাবার চাইছে, ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম চাইছে দ্রুত সেবা, আর ছোট পরিবার ও তরুণরা খুঁজছে সুবিধাজনক সমাধান।”
কিন্তু সাধারণ ভোক্তাদের অনেকেই এখনো হতাশ। যেমন, গুয়াংঝুর এক ক্রেতা কিউ রুই বলেন, “আমি সম্প্রতি এক রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম, কিন্তু অনেক রান্না করা খাবার পাওয়া যাচ্ছিল না, শুধু প্রি-মেড খাবার ছিল। কর্মীরা বললেন, ‘আজ আমাদের শেষ দিন, শুধু মজুত খাবার বিক্রি করছি।’ এরপরই দোকানটি বন্ধ হয়ে গেল।”
চীনের খাদ্য শিল্প এখন বড় একটি পরীক্ষার মুখোমুখি। ভোক্তাদের চাহিদা বদলে যাচ্ছে—তারা চাইছে মান, স্বচ্ছতা ও সঠিক মূল্যের নিশ্চয়তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রি-মেড খাবার নিজে কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু এর জন্য প্রিমিয়াম দাম নেওয়াই আসল বিতর্কের কারণ।
উ ইয়ি যেমন বললেন, “মানুষ আসলে প্রি-মেড খাবার নিয়ে ক্ষুব্ধ নয়, ক্ষুব্ধ তারা এর বাড়তি দামের জন্য। আয় কমে আসার সময়ে দামি রেস্তোরাঁয় এ ধরনের খাবার পাওয়া মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়াচ্ছে।”