আফ্রিকার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি আর শুষ্ক বনে লুকিয়ে থাকে এক ভয়ঙ্কর প্রাণী—ব্ল্যাক মাম্বা। এটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুতগামী ও প্রাণঘাতী সাপ। কয়েক মিনিটেই মানুষের স্নায়ুতন্ত্র অকেজো করে দিতে পারে এর বিষ। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কখনও কখনও অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পরও রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। কেন ঘটে এমন বিপরীত প্রতিক্রিয়া—সেই রহস্যই উন্মোচন করেছে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা।
রহস্যময় সাপের পরিচয়
ব্ল্যাক মাম্বার বৈজ্ঞানিক নাম Dendroaspis polylepis। এটি এলাপিড (Elapidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত—যে পরিবারের সদস্য কোবরা, টাইপান ও ক্রাইটের মতো উচ্চবিষাক্ত সাপও।
এর মুখের ভেতর সম্পূর্ণ কালো, তাই নাম দেওয়া হয়েছে “ব্ল্যাক মাম্বা”; তবে শরীরের রঙ সাধারণত ধূসর, খয়েরি বা সবুজাভ হয়। এই কালো মুখ শত্রুকে ভয় দেখানোর অন্যতম উপায়।
প্রাপ্তবয়স্ক ব্ল্যাক মাম্বা সাধারণত ২.৫ থেকে ৩ মিটার লম্বা হয়, তবে কখনও ৪ মিটার পর্যন্তও হতে পারে। মাথা কিছুটা কফিন-আকৃতির, দেহ লম্বা ও পাতলা—যা তাকে দ্রুতগতির চলাফেরায় সক্ষম করে।
আবাস ও আচরণ
ব্ল্যাক মাম্বা মূলত স্থলচর (terrestrial), তবে প্রয়োজনে গাছেও উঠতে পারে। শুষ্ক বনভূমি, ঝোপঝাড়, পাহাড়ি ঢাল কিংবা শিলাময় এলাকাই এর প্রিয় আবাস। দিনে সূর্যের তাপে গা গরম করে, রাতে আশ্রয় নেয় গর্ত বা পাথরের ফাঁকে।
এটি সাধারণত একাকী সাপ। শিকার ধরার সময় নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে মুহূর্তেই আঘাত করে। এর প্রিয় শিকার হলো ইঁদুর, খরগোশ, কাঠবিড়ালি ও পাখি। কামড়ের পর শিকার পালিয়ে গেলেও, বিষের প্রভাবে কয়েক মিনিটেই তা পক্ষাঘাতে মারা পড়ে। এরপর মাম্বা ধীরে ধীরে শিকারটিকে গিলে ফেলে।
হুমকির মুখে পড়লে মাম্বা মুখ খুলে কালো অভ্যন্তর দেখায় ও জোরে হিস করে। তাতে কাজ না হলে, চোখের পলকে আক্রমণ করে। ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানতে পারে—যা পৃথিবীর অন্যতম দ্রুত সাপ।
বিষ: প্রাণঘাতী রাসায়নিক অস্ত্র
ব্ল্যাক মাম্বার বিষে শতাধিক ভিন্ন প্রোটিন ও পেপটাইড থাকে। এর বেশিরভাগই নিউরোটক্সিন, যা স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে। প্রধান উপাদানগুলো হলো—
- আলফা-নিউরোটক্সিন (α-neurotoxins): স্নায়ু ও পেশীর সংকেত বন্ধ করে দেয়, ফলে পেশী নিস্তেজ হয়।
- ডেনড্রোটক্সিন (Dendrotoxins): পটাসিয়াম আয়ন চ্যানেল বাধাগ্রস্ত করে স্নায়ুকোষের অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
- ফ্যাসিকুলিন (Fasciculins): পেশীগুলিতে ক্রমাগত সংকোচন ঘটায়।
- ক্যালসিসেপ্টিন (Calciseptine): হৃদযন্ত্রের ছন্দ বিঘ্নিত করে।
- ম্যামব্যালজিনস (Mambalgins): আশ্চর্যজনকভাবে ব্যথা কমাতে সক্ষম—যা ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক ব্যথানাশক ওষুধ তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।
এই সব উপাদান একত্রে এমন এক জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটায় যা কয়েক মিনিটেই স্নায়ুতন্ত্রকে অচল করে দেয়।
বিষক্রিয়ার প্রভাব
বিষ শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তা রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা দেয় ভয়াবহ উপসর্গ—
- কামড়ের স্থানে জ্বালা ও ঝিনঝিন ভাব
- চোখের পলক পড়ে যাওয়া
- কথা জড়ানো ও গিলতে কষ্ট
- পেশী শিথিলতা ও শ্বাসকষ্ট
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
- মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত ঘাম ও অজ্ঞানতা
যদি দ্রুত চিকিৎসা না পাওয়া যায়, শ্বাসনিয়ন্ত্রণকারী পেশী অকেজো হয়ে রোগী ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
“দ্বৈত আক্রমণ” তত্ত্ব
ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, ব্ল্যাক মাম্বার বিষ একধাপ নয়—দুই ধাপে আক্রমণ চালায়।
প্রথমে এটি স্নায়ু সংকেত বন্ধ করে দেয় (postsynaptic attack), পরে স্নায়ুকোষে অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে (presynaptic stimulation)।
এই “দ্বৈত আঘাত” বা Second Strike Theory বোঝায় কেন অনেক সময় অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পরও রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
গবেষণার মূল আবিষ্কার
প্রফেসর ব্রায়ান ফ্রাই ও তাঁর দল তিনটি মাম্বা প্রজাতির বিষ বিশ্লেষণ করেন—
ব্ল্যাক মাম্বা (Dendroaspis polylepis)
ওয়েস্টার্ন গ্রিন মাম্বা (Dendroaspis viridis)
জেমসনের মাম্বা (Dendroaspis jamesoni)
তাঁরা দেখতে পান, বিষ প্রথমে পেশী শিথিল করে (flaccid paralysis), পরে হঠাৎ পেশী সঙ্কোচন ঘটায় (spastic paralysis)।
যখন অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয়, তখন প্রথম ধাপের বিষক্রিয়া বন্ধ হয়, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপের “লুকানো” টক্সিন সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে রোগীর পেশী আবার শক্ত হয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, এবং অবস্থা আরও বিপজ্জনক হয়।
প্রফেসর ফ্রাই বলেন,
“মাম্বা সাপ স্নায়ুতন্ত্রের দুইটি ভিন্ন জায়গায় একসাথে আক্রমণ চালায়। এটাই এর বিষকে এত জটিল ও প্রাণঘাতী করে তোলে।”
অ্যান্টিভেনম: কার্যপ্রণালী ও সীমাবদ্ধতা
কীভাবে কাজ করে:
অ্যান্টিভেনম হলো একধরনের প্রতিষেধক সিরাম, যা প্রাণীর শরীরে বিষ প্রয়োগ করে তৈরি করা হয়। এতে গঠিত অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করে বিশুদ্ধভাবে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়, যা বিষের প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
তবে সীমাবদ্ধতা রয়েছে:
- সব অ্যান্টিভেনম সব প্রজাতির বিষে কার্যকর নয়।
- কিছু টক্সিন (বিশেষত presynaptic অংশ) প্রতিষেধক দ্বারা ধরা পড়ে না।
- “Unmasking effect” বা লুকানো টক্সিনের সক্রিয়তা দেখা দেয়, যা প্রতিষেধক প্রয়োগের পর প্রকাশ পায়।
- আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিষের গঠন ভিন্ন হওয়ায় সব জায়গায় একই অ্যান্টিভেনম কার্যকর হয় না।
- অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগে অ্যালার্জি, জ্বর বা সিরাম অসুখ দেখা দেয়।
- গ্রামীণ অঞ্চলে অ্যান্টিভেনম ব্যয়বহুল ও অপ্রতুল, ফলে দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া কঠিন।
কেন অ্যান্টিভেনমের পরও রোগীর অবস্থা খারাপ হয়
প্রথম ধাপে α-নিউরোটক্সিন পেশী শিথিল করে, যা অ্যান্টিভেনমে দমন হয়। কিন্তু বিষের presynaptic উপাদান—বিশেষ করে ডেনড্রোটক্সিন—অতিরিক্ত স্নায়ু উত্তেজনা সৃষ্টি করে, ফলে পেশীতে হঠাৎ সঙ্কোচন শুরু হয়।
অ্যান্টিভেনমে এক অংশ নিষ্ক্রিয় হলেও অন্য অংশ তখন উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখায়, যাকে বলা হয় “দ্বিতীয় আঘাত” বা Second Strike Effect।
চিকিৎসা ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
গবেষণাটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতের প্রতিষেধক হতে হবে “মাল্টি-টার্গেটেড”—যা postsynaptic ও presynaptic উভয় বিষক্রিয়াকে একসাথে দমন করতে পারবে।
এছাড়া জরুরি চিকিৎসা প্রশিক্ষণ, স্থানীয় পর্যায়ে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ, এবং বিষনির্দিষ্ট গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিভেনম, “small molecule inhibitors” বা “synthetic peptides” ভবিষ্যতে আরও কার্যকর প্রতিষেধক তৈরির পথে দিকনির্দেশ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকৃতির ভয়ঙ্কর অথচ মুগ্ধকর রূপ
ব্ল্যাক মাম্বা শুধু এক প্রাণঘাতী সাপ নয়, বরং প্রকৃতির জটিল সৌন্দর্যের প্রতীক। এর বিষ যেমন মৃত্যু ডেকে আনে, তেমনি তার রাসায়নিক উপাদান মানব চিকিৎসায় নতুন আশার আলো জ্বালাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মাম্বার কিছু উপাদান ভবিষ্যতে ব্যথানাশক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ, যেটি একসময় মৃত্যুর প্রতীক ছিল, সেটিই এখন জীবন রক্ষার সম্ভাবনার উৎস হয়ে উঠছে।
ব্ল্যাক মাম্বা পৃথিবীর অন্যতম দ্রুত, বুদ্ধিমান ও প্রাণঘাতী সাপ। এর “দ্বৈত আক্রমণ” বিষক্রিয়া চিকিৎসা জগতে নতুন ধারণা দিয়েছে—যা অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পদ্ধতি ও স্নায়ুবিষ চিকিৎসায় পরিবর্তন আনতে পারে।
প্রকৃতির প্রতিটি ভয়ঙ্কর জিনিসের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে বিজ্ঞান, জৈব রসায়ন ও জীবনের গভীরতম রহস্য।
#ব্ল্যাক_মাম্বা #সাপের_বিষ #অ্যান্টিভেনম #University_of_Queensland #বিজ্ঞান_ফিচার #সারাক্ষণ_রিপোর্ট