ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো সংকটে ভারতেরই হতে হবে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রথম ভরসা। তিনি মনে করেন, ‘পড়শি আগে’ নীতিকে আরও শক্তিশালী করে এবং বৃহত্তর প্রতিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণের মাধ্যমে উপমহাদেশে স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা ও আস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
আঞ্চলিক সংকটে নেতৃত্ব ও সহযোগিতার বার্তা
ড. জয়শঙ্কর বলেন, “আমাদের নিজস্ব অঞ্চলে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সহযোগিতার কাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে হয়, তবে সেই অবকাঠামো গঠনের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। এটাই ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির মূল চেতনা।”
তিনি আরও যোগ করেন, “যে কোনো সংকটে ভারতকে হতে হবে গোটা উপমহাদেশের ‘go-to option’, অর্থাৎ প্রথম নির্ভরতার জায়গা।”
সোমবার নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্কুল আয়োজিত ‘আরাবল্লী সামিট’-এ বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন। সম্মেলনের মূল থিম ছিল ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অর্ডার: প্রিপেয়ারিং ফর ২০৪৭’।
বিভাজনের কৌশলগত ক্ষতি পেরিয়ে নতুন ভূরাজনৈতিক দিগন্তে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি কেবল সীমান্তের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং তাকে ‘বিস্তৃত প্রতিবেশ’ পর্যন্ত প্রসারিত হতে হবে। “বিভাজনের কারণে ভারতের কৌশলগত পরিসর যে সংকুচিত হয়েছিল, তা এখন কাটিয়ে উঠতে হবে। এ কারণেই আমরা ‘Act East’, ‘Link West’, ‘C5+1’ ও ‘Focus Africa’ উদ্যোগগুলো নিয়েছি।”
‘অস্ত্রায়িত বিশ্বে’ সক্রিয় কূটনীতির ডাক
জয়শঙ্কর সতর্ক করে বলেন, বর্তমান সময় ‘অত্যন্ত অশান্ত’ ও ‘পরিবর্তন-প্রবণ’—যেখানে প্রায় সবকিছুই ‘weaponisation’-এর মুখে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে বের হয়ে সক্রিয় ও অগ্রগামী কূটনৈতিক ভূমিকায় আসা। তিনি বলেন, “স্বাধীনতার শতবর্ষে পৌঁছাতে হলে ‘বিকশিত ভারত’-এর পথে আমাদের গতি বাড়াতে হবে।”
তিন অভ্যন্তরীণ চালিকা শক্তি: চাহিদা, জনসংখ্যা ও তথ্য
জয়শঙ্কর উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক পরিসরে ভারতের উত্থান ঘটবে তিনটি অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর নির্ভর করে—চাহিদা (Demand), জনসংখ্যা (Demographics) এবং তথ্য (Data)। তাঁর মতে, এই শক্তিগুলোর সমন্বয়ে ভারতকে ‘multi-alignment’ নীতিতে চলতে হবে।
তিনি বলেন, “নেতৃত্ব টিকে থাকবে দক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, মূল্যবোধ ও ধর্ম (dharma)-এর স্তম্ভের ওপর। সেখানে বিনয় ও দৃঢ় বিশ্বাস একসঙ্গে থাকতে হবে।” তিনি মানুষ, ধারণা ও প্রতিষ্ঠান—এই তিন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ওপর জোর দেন, যা ভারতের বৈশ্বিক অবস্থানকে আরও মজবুত করবে।
জেএনইউ সম্মেলনে ‘ভারতের কণ্ঠ’ পুনর্নির্মাণের অঙ্গীকার
এই সম্মেলন আয়োজন করে জেএনইউর স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (SIS), ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও চিন্তন রিসার্চ ফাউন্ডেশন। এটি ছিল বিদ্যালয়ের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘SIS@70’ উদ্যাপনের অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান।
জেএনইউ এক বিবৃতিতে জানায়, এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল “ভারতের আধুনিকতা ও তার সভ্যতাগত পরিচয়ের সেতুবন্ধন তৈরি করা, যেন ভারত কেবল প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারে।”
সম্মেলনের প্রধান অতিথিরা ও আলোচনার বিষয়
উদ্বোধনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন জেএনইউর চ্যান্সেলর অ্যাম্বাসাডর কানওয়াল সিবাল, উপাচার্য প্রফেসর সান্তিশ্রী ধূলিপুড়ি পান্ডে ও চিন্তন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সিশির প্রিয়দর্শী।
ডিন প্রফেসর অমিতাভ মাট্টু বলেন, “এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ইতিহাসের দুর্ঘটনা নয়, বরং নিয়তির অপরিহার্যতা।”
সম্মেলনের সূচনায় বিদ্যালয়ের ইতিহাসভিত্তিক একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক পুষ্পেশ পন্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিফলনমূলক আলোচনায় অংশ নেন প্রফেসর এস. ডি. মুনি, অশোক গুহ, কে পি বিজয়লক্ষ্মী, টি. এস. প্রতাপ সিংহ এবং আইএএস কর্মকর্তা মুগ্ধা সিনহা। তাঁরা বিদ্যালয়ের গঠনপর্বের ইতিহাস ও তা থেকে শেখার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন।