বাজারে ঐতিহাসিক উত্থান
ভিয়েতনামের প্রধান শেয়ার সূচক বুধবার সর্বকালের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। এদিন আন্তর্জাতিক সূচক সংস্থা এফটিএসই রাসেল (FTSE Russell) ঘোষণা করেছে যে দেশটিকে “ফ্রন্টিয়ার মার্কেট” থেকে উন্নীত করে “ইমার্জিং মার্কেট” বা উদীয়মান বাজার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এই ঘোষণাকে ভিয়েতনাম সরকার ও বিনিয়োগকারীরা বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রবাহের নতুন দ্বার
‘ফ্রন্টিয়ার মার্কেট’ মর্যাদায় থাকায় এতদিন বহু বিদেশি তহবিল ভিয়েতনামের স্থানীয় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারত না। এবার উন্নীত হওয়ার ফলে দেশের বাজারে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে বলে ধারণা করছে এফটিএসই রাসেল। পাশাপাশি স্থানীয় আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার ইস্যু) বাজারও নতুন গতি পাবে।
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ভিয়েতনাম এখন ভারতের ও চীনের মতো বড় উদীয়মান বাজারগুলোর সমকক্ষ অবস্থানে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রীয় সিকিউরিটিজ কমিশন এক বিবৃতিতে একে “ভিয়েতনামের বাজারের জন্য এক নতুন উন্নয়নযুগের সূচনা” বলে অভিহিত করেছে।
রেকর্ড সূচক ও দ্রুত উত্থানের পেছনের কারণ
হো চি মিন স্টক সূচক দিন শুরুতেই ২ শতাংশ বেড়ে ১,৭৩৫ পয়েন্টে পৌঁছায়—যা একটি নতুন রেকর্ড। পরে সামান্য কমলেও দিনের শেষে সূচক ১ শতাংশ বৃদ্ধিতে স্থিত থাকে। ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত সূচকটি এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই উত্থানের পেছনে রয়েছে ব্যাংক ঋণের ব্যাপক সম্প্রসারণ, সাম্প্রতিক আইপিও, নতুন তালিকাভুক্তির পরিকল্পনা এবং গত মাসে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া এফটিএসই ঘোষণার ইঙ্গিত।
তারিখ ও প্রত্যাশা
ঘোষণা অনুযায়ী, এফটিএসই রাসেলের এই উন্নয়ন কার্যকর হবে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৬ থেকে, তবে এর আগে আগামী মার্চে একটি অন্তর্বর্তী পর্যালোচনা হবে।
বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যেও ইতিবাচক বার্তা
এই সিদ্ধান্তটি এসেছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ২০ শতাংশ শুল্ক ভিয়েতনামের রপ্তানিকে বড় আঘাত দিয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি ২০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে দেশটিকে।
তবু, এই এফটিএসই উন্নয়ন বিশ্ব বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, ভিয়েতনাম তার রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাণিজ্যচাপের মধ্যেও স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম।
আইপিও বাজারে নতুন উন্মাদনা
২০০০ সালে হো চি মিন স্টক এক্সচেঞ্জে মাত্র দুটি কোম্পানি ছিল। এখন সেখানে প্রায় ৩৯০টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত, যার মধ্যে আছে হোয়া ফাত (Hoa Phat), মিলিটারি কমার্শিয়াল ব্যাংক (MBBank) এবং ভিনগ্রুপ (Vingroup)—যা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছেও সুপরিচিত নাম।
আইপিও বাজার এখনো তুলনামূলক ছোট হলেও ২০২৫ সালে এতে গতি এসেছে। ২০২৪ সালে মাত্র একটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু এই বছর ইতিমধ্যেই দুটি বড় অফার এসেছে—
- টেককম সিকিউরিটিজ (Techcom Securities): প্রায় ৪১০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে, যা কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়।
- ভিনপার্ল (Vinpearl): আতিথেয়তা খাতের প্রতিষ্ঠানটি ১৯০ মিলিয়ন ডলার তুলেছে।
এ ছাড়া আরও তিনটি কোম্পানি আইপিও পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ড্রাগন ক্যাপিটাল নামের একটি ভিয়েতনাম-কেন্দ্রিক প্রাইভেট ইক্যুইটি ফান্ড ২০২৮ সালের মধ্যে এক ডজনের মতো নতুন তালিকাভুক্তি আশা করছে।
বিশ্লেষকদের সতর্কতা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
বিশ্লেষকদের মতে, বাজার ইতিমধ্যেই এই উন্নয়ন সংক্রান্ত সম্ভাবনাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, ফলে স্বল্পমেয়াদে বড় উল্লম্ফন আশা করা যাচ্ছে না। দেশটিকে এখনো মোকাবিলা করতে হবে উচ্চ সুদের হার, ডং মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বিদেশি মালিকানার সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে।
অলস্প্রিং গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্টসের পোর্টফোলিও ম্যানেজার গ্যারি ট্যান বলেন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর জুড়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নেট বিক্রেতা ছিলেন, অর্থাৎ তারা আগাম মুনাফা তুলে নিয়েছেন উন্নয়ন ঘোষণার পূর্বাভাসে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “বিদেশি মালিকানার সীমা কমানো, বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি মূলধন আকৃষ্ট করা কঠিন হবে।”
ভিয়েতনামের বাজার উন্নীত হওয়ার এই সিদ্ধান্ত দেশটির অর্থনীতির জন্য এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে। বাণিজ্যচাপ ও শুল্কবাধা সত্ত্বেও এই উন্নয়ন প্রমাণ করছে—ভিয়েতনাম এখন বৈশ্বিক বিনিয়োগ মানচিত্রে একটি পরিপক্ব ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে রূপ নিচ্ছে।
#ভিয়েতনাম #শেয়ারবাজার #এফটিএসই #উদীয়মানবাজার #অর্থনীতি #বিনিয়োগ #আইপিও #সারাক্ষণরিপোর্ট