সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে কর্মরত ভারতীয় প্রকৌশলী হরিরাজ সুধেভন (৩৭) পরিবারের সদস্যদের বিমানবন্দরে বিদায় জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হৃদরোগে মারা গেছেন। আকস্মিক এই মৃত্যুর ঘটনায় শোকের ছায়া নেমেছে তাঁর পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের মধ্যে।
প্রবাস জীবনের হঠাৎ ট্র্যাজেডি
হরিরাজের শ্বশুর অশোকন কে.পি. বলেন, “আমরা সবাই ভেঙে পড়েছি। বিশ্বাস করতে পারছি না, সে আর নেই।” হরিরাজের স্ত্রী ডা. অনু অশোক ও ছেলে ঈশান দেব হরি ১০ দিন তাঁর সঙ্গে আমিরাতে ছিলেন। রবিবার সন্ধ্যায় তাঁরা কেরালায় ফিরে যান।
অশোকন আরও জানান, “তাদের রেসিডেন্স ভিসা আছে। তাই প্রতি ছয় মাস পরপর কয়েক দিনের জন্য তারা হরিরাজের কাছে আসে। এই মাসের শেষে ছেলের জন্মদিনে অংশ নিতে হরিরাজও কেরালায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। প্রতি বছরই সে জন্মদিনে যায়, এবারও ২৭ অক্টোবরের অনুষ্ঠানের জন্য ছুটি নিয়েছিল।”
কর্মজীবনে সফল, বন্ধুদের প্রিয়
হরিরাজ ১২ বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কাজ করছিলেন। দুবাইয়ে ১১ বছর ‘সাবসিয়া পাইপলাইন ইনস্টলেশন ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছর আবুধাবিতে ‘সিনিয়র অফশোর কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার’ পদে যোগ দেন।
তাঁর বন্ধু ডিগিন থমাস বলেন, “আমরা ১৭ বছর বয়স থেকে একসঙ্গে—ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় মুম্বাইয়ে, পরে দুবাইতেও পাশাপাশি ছিলাম।”
হরিরাজের মরদেহের সঙ্গে তিনিই কেরালার আলাপ্পুঝা জেলায় ফিরে যান। মঙ্গলবার সেখানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
শেষ দিন: আনন্দের পরেই বিপর্যয়
ডিগিন জানান, “হরিরাজ তার স্ত্রী ও ছেলেকে বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে কেরালা থেকে ফিরে আসা রুমমেট সুজিথকে তুলে নেয়। এরপর আমার বাসায় আসে, কারণ সেদিন আমার মেয়ের জন্মদিন ছিল। আমরা কেক কাটি, সে উপহার দেয়, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে—সবাই ওকে খুব ভালোবাসত।”
রাত ৯টার দিকে হরিরাজ বাসা থেকে বেরিয়ে যান। তখন তাঁর স্ত্রী ও ছেলে কেরালায় পৌঁছে ভিডিও কলে কথা বলেন। পরে রাতের খাবার খেয়ে ট্যাবলেটে কিছু দেখছিলেন।
হঠাৎ অসুস্থতা ও মৃত্যুর মুহূর্ত
রাত প্রায় ১১টা ৪০ মিনিটে হরিরাজ বুকে অস্বস্তি অনুভব করেন। তাঁর রুমমেট দ্রুত ডিগিন ও অন্য এক বন্ধুকে ফোন করেন এবং অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন।
ডিগিন বলেন, “আমি গাড়ি নিয়ে দুই মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই। অ্যাম্বুলেন্সও এসে যায়। হরিরাজের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, ঘামছিল। প্যারামেডিক টিম সিপিআর দেয়, পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আধাঘণ্টা চেষ্টা করেও ডাক্তাররা বাঁচাতে পারেননি।”
উপেক্ষিত স্বাস্থ্য সংকেত
ডিগিন জানান, “হরিরাজ ডায়াবেটিসে ভুগলেও খাদ্যনিয়ন্ত্রণ ও যোগব্যায়ামে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখত। ব্যাডমিন্টন খেলত নিয়মিত। তবে সাম্প্রতিক মেডিকেল চেকআপে ইসিজি নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছিল। পরবর্তী পরীক্ষায় ফল স্বাভাবিক আসে। খাওয়ার পর মাঝে মাঝে বুক জ্বালাপোড়ার কথা বলত, ভাবত গ্যাসের সমস্যা।”
প্রতিভাবান, বিনয়ী ও হৃদয়বান মানুষ
হরিরাজ কেরালার কুসাট (CUSAT) থেকে বি.টেক এবং আইআইটি মাদ্রাস থেকে এম.টেক সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী, শান্ত ও বিনয়ী মানুষ।
তাঁর বন্ধু ডিগিন বলেন, “প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে কথা বলত। পরিবারের সবার সঙ্গে ছিল গভীর বন্ধন। শেষকৃত্যে তাঁর দাদী, বাবা-মা, ভাই ও আত্মীয়রা উপস্থিত ছিলেন। সবার চোখে ছিল অশ্রু।”
ডুবাইয়ে কর্মরত সহকর্মী আমল গিরিশ বলেন, “সে অত্যন্ত সহায়ক ও অনুপ্রেরণাদায়ক মানুষ ছিল। তার অকাল মৃত্যু আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি।”
প্রিয়জনদের স্মৃতিতে চির অম্লান
ডিগিনের স্ত্রী সিনি সুসান সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “সে আমাদের পরিবারের প্রাণ ছিল। আনন্দ, হাসি, ভালোবাসা—সব সে এনে দিত। এখন ঘরটা ফাঁকা লাগে। আমাদের সন্তানরাও ওর হাসি আর উপহারগুলো ভুলতে পারবে না।”
#সংযুক্তআরবআমিরাত #ভারতীয়প্রকৌশলী #হৃদরোগ #কেরালা #প্রবাসজীবন #মানবিকগল্প #সারাক্ষণরিপোর্ট