অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ‘সেফ এক্সিট’ বা নিরাপদে সরে যাওয়ার উপায় খুঁজছেন অভিযোগ করে বক্তব্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির দুইজন নেতা। হঠাৎ করে কেন তারা এই প্রসঙ্গ তুললেন সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
প্রথমে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গটি তোলেন। পরে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমও একই বিষয়ে বক্তব্য দেন তাদের দলের এক সভায়।
এ নিয়ে নানা আলোচনা দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
গত বছর গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আলোচনা অংশ নিয়েছিলেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররাও। সেই সরকারে নাহিদ ইসলামসহ তিনজন ছাত্র প্রতিনিধিও ছিলেন।
কিন্তু বছর না ঘুরতেই কেন উপদেষ্টাদের নিরাপদ প্রস্থানের কথা তুলছেন এনসিপি নেতারা?
এনসিপি সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে তার দলের নেতাদের বক্তব্য এটা এনসিপিরই সামগ্রিক বক্তব্য।
“আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিচার ও সংস্কার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। সেটি পালনের দায়িত্ব নিয়েও তা না করে কোনো কোনো উপদেষ্টা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান। নাহিদ কিংবা সারজিস সেই বিষয়টিই বলেছেন,” বলেন মি. হোসেন।
‘সেফ এক্সিট’ প্রশ্ন তুললেও নাহিদ কিংবা সারজিস সুনির্দিষ্ট করে কোনো উপদেষ্টার নাম বলেননি।
এ নিয়ে মন্তব্যের জন্য তাদের দুই জনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা। তবে, তারা কেউ ফোন ধরেননি।
এদিকে, উপদেষ্টাদের কেউ কেউ কী সত্যিই সেফ এক্সিট খুঁজছে বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মুখোমুখি হয়েছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেছেন, “নাহিদ ইসলামের বক্তব্যটা স্পেসিফিক হলে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলা যেত। এখানে তো সরকারের বক্তব্য দেওয়ার তো সুযোগ নেই।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, উপদেষ্টাদের দায়িত্ব পালন করতে না পারা ব্যর্থতা, তবে ‘সেফ এক্সিটের’ প্রশ্ন আসলে সেটি মূলত একটা অনিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথাই বোঝায়।
যেভাবে আলোচনায় ‘সেফ এক্সিট’
গত শনিবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে লিঁয়াজো রেখেছে এবং তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথাও ভাবছে।
যদিও ওই সাক্ষাৎকারে মি. ইসলাম কোনো উপদেষ্টার নাম উল্লেখ করেননি।
তবে তিনি এটি বলেছেন, তারা যাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, তাদের দ্বারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব প্রতারিত হয়েছে। ‘সময় হলে’ তাদের নামও প্রকাশ করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্যের পর মঙ্গলবার প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
উত্তরের জেলা নওগাঁয় এনসিপির জেলা ও উপজেলার সমন্বয় সভা শেষে সাংবাদিকদের সামনে তিনি বলেন, “কিছু উপদেষ্টার মাঝে আমরা এই আচরণ দেখতে পাচ্ছি যে, তারা এখন কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্বটা পালন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো। দেশে থাকুন, আর দেশের বাইরে থাকুক। এই দায়সারা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অভ্যুত্থান পরবর্তী একটা সরকার কাজ করতে পারে না।”
এ সময় তিনি আরও বলেন, “কোথায় সেফ এক্সিট নেবে? পৃথিবীতে সেফ এক্সিট নেওয়ার একটাই জায়গা, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। এছাড়া কোনো সেফ এক্সিট নাই। আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে ধরবে।”
কী বলছেন এনসিপি নেতারা? কেন এই আলোচনা?
কেন, কোন প্রেক্ষাপটে ‘সেফ এক্সিটের’ কথা আনলেন–– এটা জানার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও নাহিদ ইসলাম বা সারজিস আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে এ নিয়ে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত চারজন নেতার সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিপির একজন নেতা জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদ নিয়ে এবছর মে মাসের দিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের আন্দোলনের পর থেকেই মূলত অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়।
ওই নেতা বলেন, পরে যখন প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সাথে বৈঠক করেন, তারপর থেকে সরকারের দুই থেকে তিনজন উপদেষ্টা বিএনপির সাথে সখ্য গড়ে তুলছেন। ওই উপদেষ্টাদের ‘পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের’ কারণে জুলাই সনদ নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে।
এনসিপি নেতাদের অভিযোগ, উপদেষ্টাদের আরেকটি অংশ জামায়াতের সাথেও সখ্য বজায় রেখে তাদের ‘নিরপেক্ষতা’ হারিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি এনসিপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আলোচনা পরই বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আনছেন এনসিপি নেতারা।
দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সামনের নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্য হয় সেটা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ সামনে আসছে। কারণ তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করছে না।”
“যে উপদেষ্টাদের সুষ্ঠু নির্বাচন, আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারের জন্য দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেফ এক্সিট খুঁজছেন। দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছেন,” বলেন তিনি।
এনসিপির এই নেতার কাছেও জানতে চাওয়া হয়েছিল সেই উপদেষ্টারা কারা, জবাবে তিনি কারও নাম বলেননি।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সুনির্দিষ্ট কোনো উপদেষ্টার নাম তারা এখনই না বললেও তারা মনে করেন, এই উপদেষ্টা পরিষদই জনমানুষের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
বুধবার বিষয়টি নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাছে। জবাবে তিনি এনসিপি নেতারা যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটির বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরার আহ্বান জানান।
মিজ হাসান বলেন, “এটা উনি (নাহিদ ইসলাম) অভিমান থেকে বলেছেন, নাকি উনার কোনো একটা ব্যাপারে গ্রিভেন্স (কষ্ট) আছে, এ বিষয়গুলো পরিষ্কার উনাকে করতে হবে…তাকে তার বক্তব্যকে সাবসটেনশিয়েট (প্রমাণ) করতে হবে।”
সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করলে তখন সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলে জানান তিনি।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেই ছাত্র নেতৃত্বের পরামর্শ রেখেই এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারাই কেন উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে অভিযোগ তুলছে সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ভোটের আগে এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সংকট তৈরি করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, “এই উপদেষ্টাদের তো নিয়মতান্ত্রিকভাবেই দায়িত্ব হস্তান্তর করা উচিত। সেক্ষেত্রে সেফ বা আনসেফ এক্সিটের প্রশ্ন কেন উঠবে। এখানে দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা থাকে বা কোনো অপরাধ সংগঠিত হয় সেগুলোর জন্য বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকদের মতোই তাদের বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে।”
BBC News বাংলা