সোনার ঐতিহাসিক উল্লম্ফন
প্রথমবারের মতো আউন্সপ্রতি ৪,০০০ ডলারের সীমা অতিক্রম করেছে সোনার দাম। ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার কমার প্রত্যাশা—এই সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকেছেন।
রুপার দামও বুধবার ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, সোনার রেকর্ড র্যালির সাথেই ছুটেছে এই ধাতুটি।
বাজারে বর্তমান অবস্থা
স্পট সোনা ১.৭ শতাংশ বেড়ে আউন্সপ্রতি ৪,০৫০.২৪ ডলারে লেনদেন হয়েছে (বাংলাদেশ সময় রাত ১১:৪৫টায়)। ডিসেম্বর ডেলিভারির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফিউচার সোনা একই হারে বেড়ে ৪,০৭০.৫০ ডলারে স্থির হয়।
রুপার দাম ৩.২ শতাংশ বেড়ে আউন্সপ্রতি ৪৯.৩৯ ডলারে পৌঁছেছে, যা সর্বোচ্চ ৪৯.৫৭ ডলারের কাছাকাছি।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
ম্যাথিউ পিগট, মেটালস ফোকাসের স্বর্ণ ও রুপা বিভাগের পরিচালক, বলেন,
“সোনার এই শক্তি একটি অত্যন্ত ইতিবাচক সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিফলিত করছে। নিরাপদ বিনিয়োগের অন্যান্য মাধ্যম নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।”
২০২৫ সালে সোনার দাম ইতিমধ্যে প্রায় ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৪ সালে ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির পর এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা পারফর্মিং সম্পদে পরিণত হয়েছে—শেয়ারবাজার, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও মার্কিন ডলারের তুলনায় অনেক এগিয়ে।
রুপার দামও এই বছর ৭১ শতাংশ বেড়েছে, সোনার র্যালির প্রভাব ও বাজারে সরবরাহ সংকটের কারণে।
বাজারের সংকট ও চাহিদা
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গ্লোবাল হেড অব কমোডিটি রিসার্চ সুকি কুপার বলেন,
“রুপার বাজারে সরবরাহ কমছে, লিজ রেট বাড়ছে এবং কমেক্স স্টকের রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ভারতের মৌসুমি চাহিদা এবং বিনিয়োগ তহবিলের (ETP) বড় প্রবাহ এই র্যালিকে জ্বালানি দিচ্ছে।”
র্যালির পেছনের কারণ
এই ধাতুগুলোর দাম বৃদ্ধিতে কাজ করছে একাধিক উপাদান—
- • যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমার প্রত্যাশা
- • রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
- • কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যাপক সোনা কেনা
- • বিনিয়োগ তহবিলে প্রবল অর্থপ্রবাহ
- • দুর্বল মার্কিন ডলার
পিগট বলেন,
“এই পরিস্থিতি ২০২৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে সোনার দামে বড় ধরনের পতনের কোনো কারণ আমরা দেখছি না। বরং পুরো বছর জুড়ে সোনা ৫,০০০ ডলার সীমা ছোঁয়ার চেষ্টা করবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত প্রেক্ষাপট
বুধবার অষ্টম দিনে প্রবেশ করেছে মার্কিন সরকার বন্ধ অবস্থা (shutdown), যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা ফেডের সম্ভাব্য সুদের হার কমানোর সময় ও মাত্রা বোঝার জন্য বেসরকারি উৎসের ওপর নির্ভর করছেন।
বাজার ধারণা করছে, ফেড এই মাসেই ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার কমাবে, এবং ডিসেম্বরেও আরেকটি সমান কাটছাঁট হতে পারে।
বৈশ্বিক সংকট ও সোনার চাহিদা
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধ, ফ্রান্স ও জাপানের রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে সোনায়।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত সোনাভিত্তিক ইটিএফ-এ ৬৪ বিলিয়ন ডলার প্রবাহিত হয়েছে, যার মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসেই রেকর্ড ১৭.৩ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকদের মতে, “ফিয়ার অব মিসিং আউট”—অর্থাৎ সুযোগ হারানোর ভয়—এই র্যালিকে আরও উসকে দিচ্ছে।
অন্যান্য মূল্যবান ধাতু
এই গতি অন্যান্য ধাতুতেও ছড়িয়ে পড়েছে—
- • প্লাটিনাম: ৩ শতাংশ বেড়ে আউন্সপ্রতি ১,৬৬৬.৪৭ ডলার, ফেব্রুয়ারি ২০১৩-এর পর সর্বোচ্চ।
- • প্যালাডিয়াম: ৮.৪ শতাংশ বেড়ে ১,৪৪৯.৬৯ ডলার, দুই বছরেরও বেশি সময়ের রেকর্ড।
এই ধারাবাহিক উত্থান বাজারে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এইচএসবিসি ব্যাংক ২০২৫ সালের গড় রুপার দাম আউন্সপ্রতি ৩৮.৫৬ ডলার এবং ২০২৬ সালে ৪৪.৫০ ডলার নির্ধারণ করেছে। উচ্চ সোনার দাম,
বিনিয়োগকারীদের নতুন আগ্রহ এবং অস্থির বাণিজ্যের প্রত্যাশা এর পেছনের মূল কারণ।
বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যত বাড়ছে, ততই সোনা ও রুপার মতো নিরাপদ বিনিয়োগমুখী সম্পদের আকর্ষণ বাড়ছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, আগামী বছরেও এই ধারা অব্যাহত থেকে নতুন ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে সোনার দাম।
#সোনা #রূপা #বিনিয়োগ #বাজারবিশ্লেষণ #বিশ্বঅর্থনীতি #রয়টার্স #সারাক্ষণরিপোর্ট