ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও অভিযুক্তের গ্রেপ্তার
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে প্যাসিফিক প্যালিসেডস এলাকায় গত জানুয়ারিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২ জনের মৃত্যু ও ছয় হাজারের বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়। সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৯ বছর বয়সী জোনাথন রিন্ডারকনেখ্ট নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে তদন্ত সংস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ জানিয়েছে, অভিযুক্তের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে পাওয়া প্রমাণের মধ্যে ছিল চ্যাটজিপিটিতে তৈরি এক ছবি, যেখানে একটি শহরকে জ্বলতে দেখা যায়।
আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব
২০২৫ সালের ৭ জানুয়ারি ধনী উপকূলীয় এলাকা প্যাসিফিক প্যালিসেডসের হাঁটার পথসংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে জ্বলা এই আগুনে ২৩ হাজার একর (প্রায় ৯,৩০০ হেক্টর) এলাকা পুড়ে যায়। এতে আনুমানিক ১৫০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।
এই আগুনের সঙ্গে একই দিনে লস অ্যাঞ্জেলেসের আরেক অংশে “ইটন ফায়ার” নামে অন্য এক আগুনও শুরু হয়, যাতে ১৯ জন মারা যান এবং প্রায় ৯,৪০০টি স্থাপনা ধ্বংস হয়। তার কারণ এখনো অজানা।
প্যালিসেডসের আগুনে মালিবু ও টোপাঙ্গার বিস্তীর্ণ অঞ্চলও ধ্বংস হয়। মেল গিবসন, প্যারিস হিলটন ও জেফ ব্রিজেসসহ কয়েকজন সেলিব্রিটির বাড়িও এই অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায়।
চ্যাটজিপিটি সূত্রে ধরা পড়া অভিযুক্ত
রিন্ডারকনেখ্টকে ফ্লোরিডায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং আগুন লাগিয়ে সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। বিচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি বিল এসাইলি জানান, এই গ্রেপ্তার “ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
তদন্তকারীরা জানান, পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগও আনা হতে পারে।
তদন্তে উঠে আসা চাঞ্চল্যকর তথ্য
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, নববর্ষের দিন অভিযুক্ত প্রথম আগুনটি লাগিয়েছিলেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিল “লাকম্যান ফায়ার”। তখন দমকল বাহিনী আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও তা ঘন গাছের শিকড়ের নিচে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে এবং পরবর্তীতে প্রবল বাতাসে আবার ছড়িয়ে পড়ে।
রিন্ডারকনেখ্ট ওই এলাকার প্রাক্তন বাসিন্দা ছিলেন এবং আগুনের উৎসস্থল স্কাল রক ট্রেইলহেড থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে অবস্থান করতেন। নববর্ষের রাতে উবার চালানোর পর তিনি খোলা আগুন ব্যবহার করে আগুন লাগিয়েছিলেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।
তার ফোনের অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি ১ জানুয়ারি আগুন শুরু হওয়ার সময় ঘটনাস্থলেই ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মিথ্যা তথ্য দেন বলে দাবি তদন্তকারীদের।
উবার ও ডিজিটাল প্রমাণের ভূমিকা
উবার জানায়, আগুন লাগার সময় তিনি তাদের অ্যাপে লগইন অবস্থায় ছিলেন না, তবে তদন্তে সহায়তা করার জন্য কোম্পানি ফেডারেল সংস্থাগুলোর সঙ্গে জিপিএস ডেটা শেয়ার করে। পরবর্তীতে তাকে অ্যাপ থেকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়।
অভিযুক্তের ফোন থেকে দমকল কর্মীদের আগুন নেভানোর ভিডিও, ৯১১ নম্বরে কলের রেকর্ডিং এবং চ্যাটজিপিটিতে করা প্রশ্ন পাওয়া যায়। একটি প্রশ্নে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন— “যদি কারও সিগারেট থেকে আগুন লাগে, তবে কি সে দায়ী?”
তদন্তকারীদের ধারণা, তিনি নিজের নির্দোষতা প্রমাণের জন্য “নির্দোষ ইচ্ছাকৃত কাজের প্রমাণ” তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
চ্যাটজিপিটিতে আগুন-সংক্রান্ত চিত্র সৃষ্টির প্রমাণ
তদন্তে জানা গেছে, আগুন লাগানোর পাঁচ মাস আগে তিনি চ্যাটজিপিটিতে “ডিস্টোপিয়ান পেইন্টিং” তৈরির অনুরোধ করেছিলেন— যেখানে বনজঙ্গল জ্বলছে, মানুষ আগুন থেকে পালাচ্ছে, আর সম্পদশালী একদল মানুষ দূর থেকে তা দেখে হাসছে ও আনন্দ করছে।
এক মাস পর তিনি আবার লিখেছিলেন, “আমি আমার কাছে থাকা বাইবেল পুড়িয়ে দিয়েছি। দারুণ মুক্তি লেগেছে।”
প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও তদন্ত প্রতিবেদন
লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির এক স্বাধীন তদন্তে বলা হয়, “পুরনো সতর্কবার্তা নীতিমালা”র কারণে সময়মতো সরিয়ে নেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়নি, যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করেছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউজম এই গ্রেপ্তারকে “বিধ্বস্ত নাগরিকদের জন্য ন্যায়বিচারের পথে বড় পদক্ষেপ” হিসেবে আখ্যা দেন।
অগ্নিকাণ্ডের পর লস অ্যাঞ্জেলেস ফায়ার ডিপার্টমেন্ট তাদের ৩৬ ঘণ্টার প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটি বিশদ পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, আগুনের সময় “রেড ফ্ল্যাগ” আবহাওয়ায় যথেষ্ট জনবল বা সরঞ্জাম ছিল না।
রিপোর্টে প্রায় ১০০টি চ্যালেঞ্জ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে— যার মধ্যে ছিল শুষ্ক উদ্ভিদ, প্রবল বাতাস, সীমিত পানির জোগান ও আকাশপথে অগ্নিনির্বাপণ ঘাটতি।
নতুন অন্তর্বর্তী ফায়ার চিফ রনি ভিলানুয়েভা বলেন, এই প্রতিবেদন জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে এবং ভবিষ্যতের অগ্নিকাণ্ডে প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
তিনি জানান, বিভাগটি ইতিমধ্যে যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নত করা ও প্রশিক্ষণ জোরদারের মতো বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্যাসিফিক প্যালিসেডসের এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুধু প্রাণহানি নয়, বরং প্রযুক্তি-নির্ভর অপরাধ তদন্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন মাত্রাও যুক্ত করেছে। চ্যাটজিপিটিতে তৈরি একটি চিত্রই শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তকে আইনের হাতে তুলে দেয়।
#প্যাসিফিক_প্যালিসেডস #লসঅ্যাঞ্জেলেস_আগুন #চ্যাটজিপিটি #যুক্তরাষ্ট্র #অগ্নিকাণ্ড #সারাক্ষণ_রিপোর্ট