আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, সাম্প্রতিক বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক ধাক্কা সত্ত্বেও বিশ্ব অর্থনীতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীলতা দেখিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ২০২৫ ও ২০২৬ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি সামান্য ধীর হবে, তবে তা ভয়াবহ মন্দার পথে নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অর্থনীতি: মন্দা এড়ানোর ইঙ্গিত
জর্জিয়েভা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো কিছুটা শ্লথতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তবে দেশটি গত ছয় মাস ধরে আশঙ্কিত মন্দা এড়াতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করছেন।
তিনি ওয়াশিংটনের মিলকেন ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা দেখছি, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এ বছর ও আগামী বছর সামান্যই কমবে। বিভিন্ন ধাক্কার মধ্যেও বিশ্ব অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।”
জুলাই মাসে আইএমএফ ২০২৫ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৩.০ শতাংশে এবং ২০২৬ সালের জন্য ৩.১ শতাংশে উন্নীত করেছিল। তবে নতুন বিশ্লেষণে সামান্য নিম্নগামী সংশোধন আসতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
‘অতি নিশ্চিন্ত হবেন না’: সতর্ক করলেন জর্জিয়েভা
আইএমএফ প্রধান বলেন, “বিশ্ব অর্থনীতি প্রমাণ করেছে, এর ভিতরে আছে অসাধারণ স্থিতিশীলতা। কিন্তু এখন অনিশ্চয়তা চরমে—এবং ভবিষ্যৎ পূর্বাভাসে ঝুঁকি প্রধান হয়ে উঠেছে। তাই খুব বেশি নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নয়।”
তার মতে, বিশ্ব এখন “আশার চেয়ে ভাল, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় খারাপ” অবস্থায় আছে। মধ্যমেয়াদে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৩ শতাংশে থাকবে বলে আইএমএফ পূর্বাভাস দিচ্ছে—যা মহামারির আগের ৩.৭ শতাংশ গড়ের তুলনায় অনেক কম।
বৈশ্বিক ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মাত্রা
জর্জিয়েভা বলেন, “বিশ্বজুড়ে বঞ্চনা, বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (এআই) ঘিরে সম্ভাব্য বাজার বুদবুদের ঝুঁকিও স্পষ্ট।”
তিনি জানান, অনিশ্চয়তা বর্তমানে ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং সোনার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। মার্কিন সরকার আংশিকভাবে বন্ধ থাকায় ও ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাবে এমন প্রত্যাশায় বুধবার সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৪,০০০ ডলার ছাড়িয়েছে — যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও সম্ভাব্য প্রভাব
এপ্রিলের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের গড় বাণিজ্য ওজনকৃত শুল্ক হার ২৩ শতাংশ থেকে কমে ১৭.৫ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানান জর্জিয়েভা। ফলে শুল্কের প্রভাব প্রথমে যতটা ভয়ানক মনে হয়েছিল, ততটা হয়নি।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি কোম্পানিগুলো শুল্ক খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় বা যুক্তরাষ্ট্রমুখী পণ্যের প্রবাহ অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তবে মুদ্রাস্ফীতি আবারও বাড়তে পারে।”
আর্থিক বাজারে উত্তেজনা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
তার মতে, আর্থিক বাজারের মূল্যায়ন এখন ইন্টারনেট বুদবুদের যুগের (২০০০ সালের ডটকম ধসের আগে) সমতুল্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ মনোভাবের পরিবর্তন বিশ্ব প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামাতে পারে, যা বিশেষত উন্নয়নশীল দেশের জন্য কঠিন হবে।
তিনি বলেন: “বেল্ট বেঁধে নিন, অনিশ্চয়তাই এখন নতুন বাস্তবতা।”
ঋণ, ব্যয় ও কাঠামোগত সংস্কারে আহ্বান
জর্জিয়েভা বলেন, “দেশগুলোকে এখনই টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে; সরকারি ব্যয় সংহত করতে হবে; ঋণ কমাতে হবে এবং বৈদেশিক খাতের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে।”
তিনি জানান, বৈশ্বিক সরকারি ঋণ ২০২৯ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অতিরিক্ত বৈদেশিক ঘাটতি, অনেক সময় সুরক্ষাবাদী নীতি উসকে দেয়, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক।”
আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ: এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ
- • এশিয়া: জর্জিয়েভা বলেন, এশিয়ার দেশগুলোকে পরিষেবা খাতে সংস্কার আনতে, বাণিজ্য বাড়াতে এবং আঞ্চলিক সংহতি গভীর করতে হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে জিডিপি ১.৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
- • আফ্রিকা: সাহারা-দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসাবান্ধব সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি ১০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি হতে পারে।
- • ইউরোপ: একক বাজার গঠনের কাজ সম্পন্ন করা গেলে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের গতিশীলতার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্য পৃথক পরামর্শ
- • যুক্তরাষ্ট্র: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সর্বোচ্চ ঋণের মুখে থাকা যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি টেকসই পদক্ষেপের মাধ্যমে ঋণ কমানোর আহ্বান জানান। একই সঙ্গে অবসরকালীন সঞ্চয়কে উৎসাহিত করার জন্য নীতিগত প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দেন।
- • চীন: জর্জিয়েভা বলেন, চীনের উচিত, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানো এবং রিয়েল এস্টেট খাত সংস্কার করা। পাশাপাশি শিল্পনীতিতে অতিরিক্ত সরকারি ব্যয় কমাতে হবে, যা বর্তমানে জিডিপির প্রায় ৪.৪ শতাংশের সমান।
আইএমএফ প্রধানের বক্তব্যে স্পষ্ট, বৈশ্বিক অর্থনীতি এখনও স্থিতিশীল থাকলেও, উচ্চ অনিশ্চয়তা ও ঋণের চাপ ভবিষ্যতে বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলেন, “প্রতিযোগিতা, সুশাসন এবং জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠানই হবে ভবিষ্যতের সাফল্যের চাবিকাঠি।”