যুক্তরাষ্ট্রের চিপ শিল্পে নতুন দিগন্ত
২০২৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ শিল্পে বিনিয়োগ চীন, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে শিল্প বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান সেমি (SEMI)। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি ওয়াশিংটনের স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টাই এই বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০২৭ থেকে ২০৩০: নীতিনির্ভর বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে
সেমির সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, উন্নত লজিক ও মেমোরি চিপ উৎপাদনে সরকারি নীতিভিত্তিক প্রণোদনার কারণে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৭ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে চিপ শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ হবে।
২০২৫ ও ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চিপ বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার থাকবে। এরপর তা ২০২৭ সালে ৩৩ বিলিয়ন এবং ২০২৮ সালে ৪৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এই চার বছরে মোট বিনিয়োগ প্রায় ১৫৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে, যা বিশ্বের অন্য কোনো অর্থনীতিতে দেখা যাবে না বলে জানিয়েছেন সেমির বাজার গোয়েন্দা পরিচালক ক্লার্ক সেন।
তার ভাষায়, “যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত বিনিয়োগ পরিকল্পনাগুলোর ভিত্তিতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাবে। এখনো দেখা বাকি তারা বিশ্বের অন্যদের চেয়ে বেশি খরচ করবে কিনা, তবে সরকারি প্রণোদিত উন্নত চিপ উৎপাদনের কারণে তা সম্ভাব্য।”
বৈশ্বিক ব্যয়েও রেকর্ড, নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র
সেমির বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ১২ ইঞ্চি (৩০০ মিমি) ওয়েফার উৎপাদনকারী চিপ কারখানাগুলোর জন্য বৈশ্বিক সরঞ্জাম ব্যয় ৩৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এর মধ্যে শুধু ২০২৫ সালেই প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।
চিপ সরঞ্জাম খাতে এই ব্যয় বৃদ্ধি শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা ও কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ইচ্ছার গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এআই যুগের চাহিদা ও মার্কিন নেতৃত্ব
২০২২ সালে চ্যাটজিপিটি চালুর পর থেকে ডেটা সেন্টার ও এজ কম্পিউটিংয়ের চাহিদা হু হু করে বেড়েছে, যা চিপের বৈশ্বিক বাজারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে করেছে বিনিয়োগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় উৎপাদন জোরদার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তাইওয়ানের টিএসএমসি (TSMC) যুক্তরাষ্ট্রে ১৬৫ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং টেক্সাসে ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং মার্কিন মেমোরি চিপ জায়ান্ট মাইক্রন আইডাহো, নিউইয়র্ক ও ভার্জিনিয়ায় মোট ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
জাপান, চীন ও এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর অবস্থান
সেমির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চিপ সরঞ্জামে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে, যা একই সময়ে জাপানের ৩২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগকে ছাড়িয়ে যাবে।
চীন এখনো সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন যন্ত্রপাতি কেনার দিক থেকে এগিয়ে, যেখানে ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৯৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যয় অনুমান করা হচ্ছে। তবে মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কারণে তারা এখনো মূলত পরিণত বা পুরনো প্রজন্মের চিপ উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ, উন্নত প্রসেসর চিপ নয়।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান, যারা বৈশ্বিক বাজারে টিএসএমসি, স্যামসাং ও এসকে হাইনিক্সের মতো জায়ান্টদের আবাসস্থল, তারা যথাক্রমে ৮৬ বিলিয়ন ও ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য যৌথভাবে ১৪ বিলিয়ন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে তিন বছরের এই সময়ে।
এআই জোটে নতুন চিপ চুক্তি
চিপের এই চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ শীর্ষ এআই কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান চুক্তি। এই সপ্তাহেই ওপেনএআই (ChatGPT-এর নির্মাতা) এএমডির সঙ্গে একটি বড় চুক্তি করেছে, যার আওতায় ২০২৬ সালের শেষার্ধ থেকে শুরু করে কয়েক বছরের মধ্যে তারা লক্ষাধিক এআই চিপ কিনবে—যার মোট ক্ষমতা হবে ৬ গিগাওয়াট।
এর আগেই ওপেনএআই এনভিডিয়ার সঙ্গেও অন্তত ১০ গিগাওয়াট ক্ষমতার সিস্টেম ক্রয়ের চুক্তি করেছে। এই ধারাবাহিক ক্রয়-বিক্রয় বাজারে ফাউন্ড্রি ও চুক্তিভিত্তিক চিপ উৎপাদনের চাহিদা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ইন্টেলের নতুন কৌশল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ফিনিক্সে আয়োজিত সেমিকন ওয়েস্ট সম্মেলনের এক পার্শ্ব সেশনে ইন্টেলের সিইও লিপ-বু ট্যান বলেন, “কোম্পানি তার ফাউন্ড্রি ব্যবসায় তিনগুণ বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত, সাম্প্রতিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও।”
তার মতে, “যেহেতু এআই চিপগুলো ক্রমে জটিল হচ্ছে, উন্নত প্যাকেজিংই এখন বড় প্রতিবন্ধক। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো ইন্টেলের জন্য বিরাট সুযোগ।”
সর্বশেষ বিশ্লেষণে স্পষ্ট, এআই যুগের চাহিদা ও সরকারি প্রণোদনা যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক চিপ শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র শুধু উৎপাদনে নয়, বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীন, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে ছাড়িয়ে নতুন নেতৃত্ব স্থাপন করতে যাচ্ছে।