ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও নতুন লক্ষ্য
ভিয়েতনাম নিউ ইকোনমি ফোরাম ২০২৫-এ অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা সতর্ক করেছেন—বর্তমান আউটসোর্সিং-নির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো ভিয়েতনামকে উচ্চ আয়ের দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করতে পারবে না। “ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: অভ্যন্তরীণ শক্তি থেকে বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলে” শীর্ষক এই আলোচনায় অংশ নেন প্রফেসর হোয়াং ভ্যান কুয়ং এবং ট্রান কোয়াক খানহ, যারা সরকারের নীতি-পরামর্শক পরিষদের সদস্য।
আউটসোর্সিং থেকে নিজস্ব মূল্য সৃষ্টি
ট্রান কোয়াক খানহ উল্লেখ করেন, ভিয়েতনাম স্মার্টফোন রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং সফটওয়্যার আউটসোর্সিংয়ে সপ্তম হলেও দেশটি প্রকৃত মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে খুবই পিছিয়ে। কুয়ং বলেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দেশটি “মধ্যম আয়ের ফাঁদে” পড়ে যাবে। বর্তমানে জনসংখ্যাগত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নিম্নমূল্যের শ্রম-নির্ভর অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে অগ্রগতি সীমিত করবে।
তিনি উদাহরণ দেন—একটি পোশাক কারখানায় ১০ ইউনিট মূল্যের পণ্যের মধ্যে শ্রমিক পান মাত্র ১.৫ থেকে ২ ইউনিট। এমনকি উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ হলেও আয় বাড়ে না, কারণ প্রকৃত মুনাফা বিদেশি মালিকের হাতে চলে যায়। তাই ভিয়েতনামকে এমন এক নতুন মডেলে যেতে হবে, যা দেশের অভ্যন্তরে মূল্য সংযোজন বাড়াবে।
বিশ্বায়নের সুযোগ, কিন্তু নতুনভাবে
খানহ বলেন, গত ৩০ বছরে ভিয়েতনাম রপ্তানি ও বাণিজ্যে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে ডব্লিউটিও দুর্বল এবং বহুপাক্ষিক আলোচনা স্থবির, পুরোনো রপ্তানি-কেন্দ্রিক মডেল চাপের মুখে পড়েছে। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, বিশ্বায়ন এখনো ভিয়েতনামের উন্নয়নের অপরিহার্য চালিকা শক্তি, যদি দেশটি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তা কাজে লাগায়।
তিনটি পথ: রপ্তানি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও মূল্য সংযোজন
খানহ তিনটি মূল দিক তুলে ধরেন—
১. রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে বৈশ্বিক একীকরণে আরও স্মার্ট কৌশল গ্রহণ।
২. অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো, বিশেষ করে জনগণের ভোগ ও বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই বৃদ্ধি।
৩. রপ্তানির পণ্যে দেশীয় মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি ৫০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি থেকে ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ মূল্য রাখে (১০০ বিলিয়ন), সেটি ৩০ শতাংশে বাড়ালে আয় হবে ১৫০ বিলিয়ন—রপ্তানি না বাড়িয়েও।
অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে রূপান্তর
প্রফেসর কুয়ং বলেন, ধীরে ধীরে বিদেশি কাঁচামাল ও প্রযুক্তির পরিবর্তে দেশীয় উৎপাদন ব্যবহার করলে স্থানীয় মূল্য বৃদ্ধি পাবে। টেক্সটাইল খাতে যদি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উপকরণে নির্ভরতা বাড়ানো যায়, তবে আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব।
একইসঙ্গে, তিনি প্রস্তাব করেন ভিয়েতনামকে নতুন প্রযুক্তি খাতে—যেমন সেমিকন্ডাক্টর বা ড্রোন উৎপাদনে—অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। শুধু চিপ প্যাকেজিং নয়, বরং গবেষণা, নকশা ও প্রাথমিক উৎপাদন পর্যায়ে অংশ নিতে হবে।
নতুন প্রযুক্তি ও ঝুঁকি নেওয়ার সাহস
দুইজন বিশেষজ্ঞই একমত হন যে নতুন প্রযুক্তি-নির্ভর খাতে প্রবেশে ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু যদি ভিয়েতনাম অপেক্ষা করে, তবে সবসময় পিছিয়ে থাকবে। তাই রাষ্ট্রীয় সমর্থন, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও সাহসী নীতি গ্রহণ অপরিহার্য।
খানহ বলেন, দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী, প্রযুক্তিতে আগ্রহ এবং মেধা—এই তিন শক্তি ভিয়েতনামকে দ্রুত এগিয়ে নিতে পারে।
বাজারই নির্ধারণ করবে দিকনির্দেশ
খানহ বলেন, সরকারকে নির্দিষ্ট খাত বেছে দেওয়ার দরকার নেই—বাজার ও উদ্যোক্তারাই ঠিক করবে কোন খাতে দেশ এগোবে। তিনি উল্লেখ করেন, পার্টির সাম্প্রতিক নীতি যেমন রেজোলিউশন নং ৫৭ (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন) এবং রেজোলিউশন নং ৬৮ (বেসরকারি খাতের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য) অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্র তৈরি করছে।
প্রচলিত খাতের শক্তি ও নতুন সম্ভাবনা
উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ভিয়েতনামের টেক্সটাইল খাত ইতিমধ্যেই ২০ শতাংশ থেকে ৪৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত দেশীয় মূল্য সংযোজন অর্জন করেছে। সঠিক নীতি, প্রচেষ্টা ও বাজার সংযোগ থাকলে এসব ঐতিহ্যবাহী খাত দ্রুত আত্মনির্ভর হতে পারবে।
নতুন খাত যেমন ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্যসেবা, পর্যটন, সেমিকন্ডাক্টর ও ডেটা প্রক্রিয়াকরণেও সম্ভাবনা রয়েছে, যদিও এতে ধীরে অগ্রগতি হবে।
সরকার, মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়িক খাতের যৌথ ভূমিকা
খানহ বলেন, উন্নয়নের জন্য তিন পক্ষের সমন্বয় অপরিহার্য—সরকার, মন্ত্রণালয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা হবে মূল চালিকা শক্তি, মন্ত্রণালয় নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করবে, আর সরকার তৈরি করবে সহায়ক পরিবেশ।
নীতি হতে হবে বাস্তবভিত্তিক ও উদ্ভাবন-নির্ভর। সরকার বাজার খুলে দেবে, আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামবে।
নীতিনির্ধারণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
প্রফেসর কুয়ং বলেন, যদি ভিয়েতনাম সত্যিই বিশ্বমানের শিল্প গড়তে চায়, তবে নীতিকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে সক্ষম করে তুলবে। সরকারের লক্ষ্য হবে ঝুঁকি হ্রাস ও বাজার সৃষ্টি—যেমন সেমিকন্ডাক্টর খাতে রাষ্ট্রীয় ক্রয় কর্মসূচির মাধ্যমে।
খানহ বলেন, দ্রুত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ঝুঁকি আসে, তাই সরকারের ভূমিকা হবে সেই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করা। রাষ্ট্রকে এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে উদ্যোক্তারা স্বাধীনভাবে উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে পারেন।
ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধির পথে
দুই বিশেষজ্ঞের মতে, গত তিন দশকে ভিয়েতনাম রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতিতে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে এখন সময় এসেছে এই মডেলকে পুনর্গঠন করার—রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার ও ভোগের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
খানহের কথায়, “আমাদের সরকার দিকনির্দেশনা দেবে, নীতি পরিবেশ তৈরি করবে, ব্যবসায়ীরা উদ্যোগ নেবে—আর এই সমন্বয়েই ভিয়েতনাম তার নতুন অর্থনৈতিক যুগে প্রবেশ করবে।”