রেকর্ড ভাঙা সোনার দাম
চলতি বছর সোনার দামে দেখা গেছে অভূতপূর্ব উত্থান। সপ্তাহের শুরুতে আরও ২.৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি আউন্সের দাম প্রথমবারের মতো ৪,০০০ ডলার ছুঁয়েছে। এই উত্থান কেবল বাজারের প্রতিক্রিয়া নয়—বরং এটি বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার প্রতিফলন।
জাপানের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও মুদ্রানীতি প্রভাব
শনিবার জাপানে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। অর্থনৈতিক প্রণোদনার পক্ষে থাকা এই নেত্রীর মনোনয়ন ঘোষণার পর ইয়েনের মান কমে যায়, আর জাপানি শেয়ারবাজার ও বন্ডের মুনাফা বেড়ে যায়। তাঁর নরম মুদ্রানীতি, ব্যাংক অব জাপানের সুদের হার না বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়, যা সোনার দামের উল্লম্ফনকে আরও উৎসাহিত করেছে।
পপুলিস্ট রাজনীতি ও মুদ্রার প্রতি আস্থা সংকট
শুধু জাপান নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও ঋণসঙ্কুল অর্থনীতি ও জনমুখী রাজনীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আস্থা নড়বড়ে করছে।
ব্রিটেনে রিফর্ম ইউকে দলের নেতা নাইজেল ফারাজ ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের বন্ড বিক্রির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন, কারণ এতে সুদের হার বাড়ছে এবং করদাতাদের ক্ষতি হচ্ছে।
ফ্রান্সেও রাজনৈতিক অস্থিরতা তীব্র — এক বছরে চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হারিয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে ফ্রান্স ও জার্মানিতে ইউরোবিরোধী পপুলিস্ট দলগুলো জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যাচ্ছে।
সোনার দৌড়ের তিন ধাপ
১. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী ধাক্কা:
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্থগিত করার পর নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সোনার চাহিদা বেড়ে যায়।
২. ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ:
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বব্যবস্থায় ডলারের প্রভাব কমিয়ে দেয়, ফলে সোনার দাম আবার বাড়ে।
৩. ফেডের সুদহ্রাস সংকেত:
আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ যখন কর্মসংস্থান দুর্বলতার কারণে সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দেয়, তখন বাজারে ‘ডলার দুর্বলতা’র আশঙ্কা তৈরি হয়। ট্রাম্পের ফেড নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাও এই অনিশ্চয়তা আরও বাড়ায়।
‘ডিবেসমেন্ট ট্রেড’ অর্থাৎ বাজারের নতুন উন্মাদনা
ওয়াল স্ট্রিট এখন এই প্রবণতাকে বলছে ‘ডিবেসমেন্ট ট্রেড’, অর্থাৎ মুদ্রার মানহ্রাসের বিরুদ্ধে সোনায় বিনিয়োগ।
সোনার প্রকৃত মূল্যায়ন করা কঠিন, কারণ এটি কোনো আয় উৎপাদন করে না। কিন্তু ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময় সোনাই নিরাপদ আশ্রয়।
ফান্ড ম্যানেজার সিটাডেলের প্রধান কেন গ্রিফিন বলেন, “বিশ্বজুড়ে এখন মানুষ সোনাকেই সেই নিরাপদ সম্পদ হিসেবে দেখছে, যেভাবে একসময় ডলারকে দেখা হতো।”
ডলারের স্থিতি ও ‘ফিয়াট’ মুদ্রার প্রতি আস্থা হ্রাস
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের রবিন ব্রুকসের মতে, আগস্ট থেকে ডলার স্থিতিশীল থাকলেও সোনার উত্থান দেখায় — মানুষের আস্থা কমছে সব ধরনের ‘ফিয়াট’ অর্থব্যবস্থার প্রতি, যা কোনো বাস্তব সম্পদের ভিত্তিতে টিকে নেই।
ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি ও রাজস্ব ঘাটতির ফাঁদ
জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ — তিন অঞ্চলেই ঋণ এখন জিডিপির শতকরা ১০০-এর কাছাকাছি।
২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আর্থিক মন্দা ও কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে ঋণ বেড়েছে, যদিও তখন সুদের হার ছিল কম।
কিন্তু এখন মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদের হারও দ্রুত বাড়ছে, যা ‘ঋণ টেকসইতা’র জন্য ভয়াবহ সংকেত।
মরগ্যান স্ট্যানলি জানিয়েছে, “গত বছর জুড়ে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি কমেছে, ঋণের খরচ বেড়েছে আর বাজেট ঘাটতি বেড়েছে — একটি ত্রিমুখী বিপর্যয়।”
তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ঋণ পরিষেবার খরচ জিডিপি প্রবৃদ্ধির সমান হয়ে যাবে। এর থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে বড় ধরনের ব্যয়সংকোচন বা কর বৃদ্ধি করতে হবে, যা রাজনৈতিকভাবে কঠিন সিদ্ধান্ত।
ট্রাম্পের ‘সহজ সমাধান’ ও ফেডের নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা
ট্রাম্পের মতে, ঘাটতি কমানোর সহজ উপায় হলো সুদের হার কমানো।
এমন নীতিকে বলা হয় ‘ফিসকাল ডমিন্যান্স’, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের আর্থিক স্বার্থ রক্ষা করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে।
মরগ্যান স্ট্যানলির প্রধান অর্থনীতিবিদ সেথ কার্পেন্টার বলেন, ট্রাম্প যদি আবার ফেডের নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তার করেন, তাহলে ডলার দুর্বল হবে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে এবং সোনার দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে।’
জাপানের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা
জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি গত বছর ব্যাংক অব জাপানের সুদবৃদ্ধি নীতিকে “মূর্খতা” বলেছিলেন। এখন তিনি কিছুটা নরম হলেও, অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনায় সরকারের ভূমিকা জোর দিয়ে বলেছেন।
বর্তমানে ১০ বছরের জাপানি বন্ডের ফলন ১.৬% হলেও, ৩০ বছরের বন্ডের ফলন বেড়ে ভবিষ্যতে চার শতাংশের উপরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ব্রুকসের মতে, বাজার এখন বুঝে ফেলেছে — ঋণ কমানো সম্ভব নয়, তাই দীর্ঘমেয়াদে দেশগুলো মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে সেই ঋণ ‘গলিয়ে’ দেবে।
বিশ্বজুড়ে ঋণের ভার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নরম নীতি মিলে বিনিয়োগকারীদের একটাই বার্তা দিচ্ছে —সোনা এখন আর কেবল গহনা নয়, বরং আস্থার নতুন মুদ্রা।
#সোনা #বিশ্বঅর্থনীতি #মুদ্রানীতি #কেন্দ্রীয়ব্যাংক #ডলার #জাপান #ট্রাম্প #সারাক্ষণরিপোর্ট