কক্সবাজারে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে জেলার প্রথম রিসাইক্লিং কারখানার যাত্রা শুরু হয়েছে।পরিবেশবান্ধব এই উদ্যোগটি প্লাস্টিক দূষণ হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
প্লাস্টিক বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের উদ্যোগ
রামু উপজেলার মিঠাছড়ি এলাকায় স্থাপিত এই কারখানাটি কক্সবাজারে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর কারখানাটির উদ্বোধন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি সংস্থার অংশগ্রহণ
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বুশরা বিশাদ, ইউএনওপিএস (UNOPS)-এর বাংলাদেশের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার থমাস ওয়ারি, কক্সবাজার পৌর প্রশাসক সানজাম উল্লাহ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম মাজহার প্রমাণিক, পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তার, ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক ড. তামোহা শিরিন আলী এবং মানবিক সংকট ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (HCMP)-এর সহকারী পরিচালক জাউল কাদেরসহ আরও অনেকে।
পর্যটন ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর চাপে বর্জ্যের বৃদ্ধি
পর্যটননির্ভর শহর কক্সবাজারে বিপুলসংখ্যক স্থানীয় জনগণ ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থীর কারণে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই জেলায় দৈনিক প্রায় ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর বড় অংশই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক—যেমন পলিথিন, বোতল, প্যাকেটজাত পণ্যের মোড়ক ইত্যাদি—যা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা কঠিন এবং বাজারমূল্যও কম। নতুন এই রিসাইক্লিং কারখানাটি এসব বর্জ্য থেকে টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও দৃঢ় মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করবে।
পরিবেশবান্ধব উদাহরণ হিসেবে নতুন কারখানা
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, “এই উদ্যোগ টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি একদিকে পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে নারী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।” তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য জেলাতেও এই মডেল অনুসরণ করা হবে।
স্থানীয় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি
ইউএনওপিএস-এর টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার থমাস ওয়ারি বলেন, “এটি এমন একটি দৃষ্টান্ত যেখানে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে ইউএনওপিএস টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করছে।”
ব্র্যাকের পরিচালক ড. তামোহা শিরিন আলী জানান, ‘PLEASE’ প্রকল্পের আওতায় ব্র্যাক দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে কাজ করছে। পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় স্থাপিত এই কারখানার মাধ্যমে প্লাস্টিক সংগ্রাহক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও উৎপাদক—সব শ্রেণির মানুষ সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন।
আধুনিক প্রযুক্তি ও উৎপাদন সক্ষমতা
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম মাজহার প্রমাণিক জানান, এই কারখানার পাশেই কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অতিরিক্ত স্থাপনা তৈরির কাজ চলছে। ভবিষ্যতে এখানে একটি মডেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
‘PLEASE’ প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত এই কারখানাটি বিশ্বব্যাংক ও ইউএনওপিএস-এর সহায়তায় সাউথ এশিয়া কোঅপারেটিভ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (SACEP)-এর বাস্তবায়নে নির্মিত হয়েছে। ব্র্যাক স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
৫,২৮০ বর্গফুট আয়তনের এই কারখানায় প্রতি ঘণ্টায় ২০০ কেজি পর্যন্ত প্লাস্টিক বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে এখানে রয়েছে উন্নত বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা (EPP), সোলার পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট ইউনিট, ইলাস্টিক সেপারেশন সিস্টেম এবং ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং সুবিধা।
নারী অংশগ্রহণ ও উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষা
কারখানাটি নারীদের কর্মসংস্থানে উৎসাহিত করবে এবং প্লাস্টিক সংগ্রাহকদের জীবনমান উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, খাল-বিল ও উপকূলীয় অঞ্চলে প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসে এই প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
#কক্সবাজার #প্লাস্টিক_রিসাইক্লিং #টেকসই_উন্নয়ন #পরিবেশবান্ধব #বর্জ্য_ব্যবস্থাপনা #সারাক্ষণ_রিপোর্ট