০৬:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫
ট্রাম্প প্রশাসন গ্রিনল্যান্ডের মেরু ভালুক রক্ষায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের পরিকল্পনা নর্থ ক্যারোলিনায় আউটার বাংকসে সমুদ্রে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি সোমালিয়ায় সংক্রামক রোগের কেস তিন মাসে দ্বিগুণ আফ্রিকায় মার্কিন সহায়তা কাটছাঁটে ওষুধ-সরঞ্জামের ঘাটতি বাড়ছে সাবেক নৌবাহিনী প্রধান সরওয়ার জাহান নিজাম আর নেই ইথিওপিয়ার গামবেলা শরণার্থী ক্যাম্পে ম্যালেরিয়া রোগী দ্বিগুণের বেশি ঢাকার শাহবাগে তিন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার ডিআর কঙ্গোয় ইবোলা: সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত, তবু সতর্কতা জরুরি ২৪ ঘণ্টায় নতুন ৩০৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ইসরায়েলে গাজা টাস্কফোর্সে সহায়তায় ২০০ মার্কিন সেনা: সমন্বয়, লজিস্টিকস ও পরিকল্পনায় ফোকাস

হাঙ্গেরির ‘প্রলয়ের গুরু’ ক্রাস্নাহরকাই জিতলেন ২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার

সারসংক্ষেপ

  • ক্রাস্নাহরকাই ‘মধ্য ইউরোপীয় ঐতিহ্যের এক মহান মহাকাব্যিক লেখক’
  • বিজয়ী বলেন, তিনি মূলত একটি বইই লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন
  • দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান যিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জিতলেন
  • তাঁর সাফল্যের সূচনা ঘটে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘সাতান্তাঙ্গো’ দিয়ে
  • এ সপ্তাহে ঘোষিত এটি চতুর্থ নোবেল পুরস্কার

শিল্পের শক্তিতে প্রলয়ের মাঝেও মানবতার বার্তা

হাঙ্গেরিয়ান লেখক লাস্লো ক্রাস্নাহরকাই বৃহস্পতিবার ২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। সুইডিশ একাডেমি জানায়, “তার শক্তিশালী ও দূরদর্শী রচনাসমগ্র প্রলয়ের ভয়াবহতার মাঝেও শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে।”

একাডেমির ভাষায়, “লাস্লো ক্রাস্নাহরকাই মধ্য ইউরোপীয় ঐতিহ্যের এক মহান মহাকাব্যিক লেখক, যার ধারা ফ্রাঞ্জ ক্যাফকা থেকে থমাস বার্নহার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত এবং যার লেখায় অযৌক্তিকতা ও অতিরঞ্জিত করুণার এক অনন্য মিশ্রণ রয়েছে।”

এই পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোন (প্রায় ১২ লাখ মার্কিন ডলার)।

একাডেমি আরও জানিয়েছে, “তিনি কেবল পশ্চিমা সাহিত্যিক ধারাতেই সীমাবদ্ধ নন; পূর্বের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে তিনি আরও গভীর, চিন্তাশীল ও সূক্ষ্ম সুর তৈরি করেছেন।”


“আমার জীবন এক অবিরাম সংশোধন”

সুইডিশ রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৭১ বছর বয়সী ক্রাস্নাহরকাই বলেন, তিনি মূলত মাত্র একটি বই লেখার ইচ্ছে করেছিলেন। কিন্তু নিজের প্রথম উপন্যাস “সাতান্তাঙ্গো” পড়ে তিনি আরেকটি বই লেখার অনুপ্রেরণা পান। “আমার জীবন আসলে এক স্থায়ী সংশোধন,” তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ‘তিক্ততা’।
“আমি যখন বর্তমান বিশ্বের অবস্থা নিয়ে ভাবি, তখন অত্যন্ত বিষণ্ণ হই—এই দুঃখই আমার গভীরতম অনুপ্রেরণা,” তিনি বলেন নোবেল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তিনি সেখানে অসুস্থ এক বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন।


ক্যাফকা থেকে প্রাচ্যের প্রভাব

ক্রাস্নাহরকাইয়ের উপন্যাসগুলোতে স্থান পরিবর্তন ঘটে ইউরোপের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে হাঙ্গেরি ও জার্মানির ছোট শহরগুলোতে, তারপর তিনি চলে যান দূর প্রাচ্যে—চীন ও জাপানে তাঁর ভ্রমণ সেখানে গভীর ছাপ ফেলেছিল।

আমেরিকান সমালোচক সুসান সনট্যাগ একসময় তাঁকে সমকালীন সাহিত্যের “প্রলয়ের গুরু” আখ্যা দেন। এই মন্তব্যটি তিনি করেছিলেন ক্রাস্নাহরকাইয়ের দ্বিতীয় উপন্যাস “Melancholy of Resistance” পড়ার পর।

ক্রাস্নাহরকাই ২০০২ সালে নোবেলজয়ী ইমরে কেরতেজের পর দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান, যিনি সাহিত্য নোবেল জিতলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি জন্ম নেন হাঙ্গেরির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ছোট শহর জিউলায়, রোমানিয়া সীমান্তের কাছে।


‘সাতান্তাঙ্গো’: এক বিপ্লবী সূচনা

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস “সাতান্তাঙ্গো” হাঙ্গেরির সাহিত্যে এক আলোড়ন তোলে।
একাডেমি জানিয়েছে, “এই উপন্যাসটি কমিউনিজম পতনের আগে হাঙ্গেরির গ্রামীণ অঞ্চলের এক পরিত্যক্ত সমবায় খামারে বসবাসকারী একদল নিঃস্ব মানুষের গল্প—যেখানে সবাই অপেক্ষা করছে এক অলৌকিক ঘটনার।”

উপন্যাসটির শুরুতেই ফ্রাঞ্জ ক্যাফকার একটি উদ্ধৃতি এই আশার ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে দেয়:
“তাহলে আমি অপেক্ষা করতে করতেই সেই ঘটনাটি মিস করব।”

ক্রাস্নাহরকাই নিজেও ক্যাফকার “দ্য ক্যাসল” উপন্যাসকে তাঁর অন্যতম প্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যখন আমি ক্যাফকা পড়ি না, তখন আমি তাঁর কথা ভাবি; যখন ভাবি না, তখন তাঁর চিন্তা করা আমার অভ্যাসটিকেও মিস করি।”


ওরবানকে তীব্র সমালোচনা

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের কট্টর সমালোচক ক্রাস্নাহরকাই তাঁর সরকারকে “মনোরোগের কেস” বলে আখ্যা দিয়েছেন ইউক্রেন যুদ্ধের অবস্থান নিয়ে। ওরবান কিয়েভকে সামরিক সহায়তার বিপক্ষে এবং যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার পক্ষে।

তিনি দ্য ইয়েল রিভিউ-কে বলেন, “রাশিয়া যখন প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করে, তখন কোনো দেশ কীভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারে?”

তবু খবর প্রকাশের পর ওরবান সামাজিক মাধ্যমে এক সংক্ষিপ্ত বার্তায় লেখেন,
“লাস্লো ক্রাস্নাহরকাই, হাঙ্গেরির নোবেল সাহিত্য বিজয়ী, আমাদের জাতিকে গর্বিত করেছেন। অভিনন্দন।”


স্বাধীনতার স্বাদ

ক্রাস্নাহরকাইয়ের লেখায় অনেকটাই ফুটে ওঠে ১৯৮০-এর দশকের মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতা। ১৯৮৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট শাসিত হাঙ্গেরি ছেড়ে পশ্চিম বার্লিনে চলে যান।
সেখানে তিনি পান এমন এক “গণতান্ত্রিক পরিবেশ”, যা আগে কখনো অনুভব করেননি।

তিনি বলেন, “সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমি স্বাধীনতার স্বাদ ভুলতে পারিনি।”


২১ শতকের পাঠকের জন্য অন্ধকার বাস্তবতা

লিনকন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেসন হুইটাকার বলেন, ক্রাস্নাহরকাইয়ের লেখা আজকের পাঠকদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক—বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে।

“আমরা ২০তম শতাব্দীর শেষে যে আশার পৃথিবী চেয়েছিলাম, তার বদলে ২১ শতকে প্রবেশ করেছি এক অন্ধকার ও শত্রুভাবাপন্ন সময়ে,” বলেন হুইটাকার।
“‘সাতান্তাঙ্গো’র মতো উপন্যাসের অন্ধকার রসিকতা ও নিরানন্দ বাস্তবতা এখন আরও বেশি পাঠকের মনে অনুরণন তৈরি করবে।”


চলচ্চিত্রে রূপ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ক্রাস্নাহরকাইয়ের দীর্ঘদিনের সহযোগী ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক বেলা টার। তাঁর বেশ কিছু রচনা টার চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে “সাতান্তাঙ্গো”—যার দৈর্ঘ্য সাত ঘণ্টারও বেশি—এবং “দ্য ভার্কমাইস্টার হারমোনিস”

টার বলেন, “আমি ‘সাতান্তাঙ্গো’ পড়েই বুঝেছিলাম, এর উপর ভিত্তি করে আমাকে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতেই হবে।”

১৯৯৩ সালে ক্রাস্নাহরকাই “The Melancholy of Resistance” উপন্যাসের জন্য জার্মান বেস্টেনলিস্ট পুরস্কার পান।
উপন্যাসটিতে এক ভৌতিক সার্কাসের আগমন এবং একটি বিশাল তিমির মৃতদেহকে ঘিরে নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ ফুটে ওঠে।

সুইডিশ একাডেমির মতে, “স্বপ্নময় দৃশ্য ও বিকট চরিত্রায়নের মাধ্যমে উপন্যাসটি শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার নির্মম সংঘাতকে প্রকাশ করেছে—যেখানে কেউই ভয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।”

তিনি ২০১৫ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারও জিতেছিলেন।


২০২৫ সালের চতুর্থ নোবেল পুরস্কার

সুইডিশ উদ্ভাবক ও ব্যবসায়ী আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছানুসারে ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শান্তিতে অসামান্য অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়ে আসছে।

সাহিত্য পুরস্কারজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন ফরাসি কবি সুলি প্রুডহোম (প্রথম বিজয়ী), আমেরিকান লেখক উইলিয়াম ফকনার (১৯৪৯) এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (১৯৫৩)।

গত বছর দক্ষিণ কোরীয় লেখিকা হান কাঙ এই পুরস্কার জেতেন—তিনি ছিলেন ১৮তম নারী এবং প্রথম কোরীয় যিনি এই সম্মান লাভ করেন।


(১ মার্কিন ডলার = ৯.৩৪২০ সুইডিশ ক্রোন)

রিপোর্ট: সাইমন জনসন ও ইয়োহান আহল্যান্ডার (স্টকহোম), জুস্টিনা পাভলাক (ওয়ারশ), অতিরিক্ত প্রতিবেদন: ক্রিস্তিনা থান (বুদাপেস্ট), তের্যে সলসভিক (ওসলো), গ্রেটা রোসেন ফনদান, নিক্লাস পলর্ড, মারি মানেস (স্টকহোম); সম্পাদনা: অ্যালেক্স রিচার্ডসন ও রস রাসেল


লেখক পরিচিতি

ক্রিস্তিনা থান হাঙ্গেরির চিফ করেসপন্ডেন্ট এবং সেন্ট্রাল ও ইস্টার্ন ইউরোপ ব্যুরোর ডেপুটি ব্যুরো প্রধান।
২০০৮ সালে তিনি বুদাপেস্ট ব্যুরোর প্রধান হন, যখন হাঙ্গেরি গভীর আর্থিক সংকটে ছিল।
তিনি ২০১৫ সালের অভিবাসন সংকট, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক পরিবর্তন, মুদ্রা সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন।
তিনি বুদাপেস্টের ওইটোভোস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও রুশ সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
১৯৯০-এর দশকে তিনি মস্কো, যুক্তরাষ্ট্র ও স্কটল্যান্ডে বিভিন্ন বৃত্তিতে অধ্যয়ন করেন।

জনপ্রিয় সংবাদ

ট্রাম্প প্রশাসন গ্রিনল্যান্ডের মেরু ভালুক রক্ষায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের পরিকল্পনা

হাঙ্গেরির ‘প্রলয়ের গুরু’ ক্রাস্নাহরকাই জিতলেন ২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার

১০:৩৯:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

সারসংক্ষেপ

  • ক্রাস্নাহরকাই ‘মধ্য ইউরোপীয় ঐতিহ্যের এক মহান মহাকাব্যিক লেখক’
  • বিজয়ী বলেন, তিনি মূলত একটি বইই লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন
  • দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান যিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জিতলেন
  • তাঁর সাফল্যের সূচনা ঘটে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘সাতান্তাঙ্গো’ দিয়ে
  • এ সপ্তাহে ঘোষিত এটি চতুর্থ নোবেল পুরস্কার

শিল্পের শক্তিতে প্রলয়ের মাঝেও মানবতার বার্তা

হাঙ্গেরিয়ান লেখক লাস্লো ক্রাস্নাহরকাই বৃহস্পতিবার ২০২৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। সুইডিশ একাডেমি জানায়, “তার শক্তিশালী ও দূরদর্শী রচনাসমগ্র প্রলয়ের ভয়াবহতার মাঝেও শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে।”

একাডেমির ভাষায়, “লাস্লো ক্রাস্নাহরকাই মধ্য ইউরোপীয় ঐতিহ্যের এক মহান মহাকাব্যিক লেখক, যার ধারা ফ্রাঞ্জ ক্যাফকা থেকে থমাস বার্নহার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত এবং যার লেখায় অযৌক্তিকতা ও অতিরঞ্জিত করুণার এক অনন্য মিশ্রণ রয়েছে।”

এই পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোন (প্রায় ১২ লাখ মার্কিন ডলার)।

একাডেমি আরও জানিয়েছে, “তিনি কেবল পশ্চিমা সাহিত্যিক ধারাতেই সীমাবদ্ধ নন; পূর্বের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে তিনি আরও গভীর, চিন্তাশীল ও সূক্ষ্ম সুর তৈরি করেছেন।”


“আমার জীবন এক অবিরাম সংশোধন”

সুইডিশ রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৭১ বছর বয়সী ক্রাস্নাহরকাই বলেন, তিনি মূলত মাত্র একটি বই লেখার ইচ্ছে করেছিলেন। কিন্তু নিজের প্রথম উপন্যাস “সাতান্তাঙ্গো” পড়ে তিনি আরেকটি বই লেখার অনুপ্রেরণা পান। “আমার জীবন আসলে এক স্থায়ী সংশোধন,” তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ‘তিক্ততা’।
“আমি যখন বর্তমান বিশ্বের অবস্থা নিয়ে ভাবি, তখন অত্যন্ত বিষণ্ণ হই—এই দুঃখই আমার গভীরতম অনুপ্রেরণা,” তিনি বলেন নোবেল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তিনি সেখানে অসুস্থ এক বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন।


ক্যাফকা থেকে প্রাচ্যের প্রভাব

ক্রাস্নাহরকাইয়ের উপন্যাসগুলোতে স্থান পরিবর্তন ঘটে ইউরোপের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে হাঙ্গেরি ও জার্মানির ছোট শহরগুলোতে, তারপর তিনি চলে যান দূর প্রাচ্যে—চীন ও জাপানে তাঁর ভ্রমণ সেখানে গভীর ছাপ ফেলেছিল।

আমেরিকান সমালোচক সুসান সনট্যাগ একসময় তাঁকে সমকালীন সাহিত্যের “প্রলয়ের গুরু” আখ্যা দেন। এই মন্তব্যটি তিনি করেছিলেন ক্রাস্নাহরকাইয়ের দ্বিতীয় উপন্যাস “Melancholy of Resistance” পড়ার পর।

ক্রাস্নাহরকাই ২০০২ সালে নোবেলজয়ী ইমরে কেরতেজের পর দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান, যিনি সাহিত্য নোবেল জিতলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি জন্ম নেন হাঙ্গেরির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ছোট শহর জিউলায়, রোমানিয়া সীমান্তের কাছে।


‘সাতান্তাঙ্গো’: এক বিপ্লবী সূচনা

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস “সাতান্তাঙ্গো” হাঙ্গেরির সাহিত্যে এক আলোড়ন তোলে।
একাডেমি জানিয়েছে, “এই উপন্যাসটি কমিউনিজম পতনের আগে হাঙ্গেরির গ্রামীণ অঞ্চলের এক পরিত্যক্ত সমবায় খামারে বসবাসকারী একদল নিঃস্ব মানুষের গল্প—যেখানে সবাই অপেক্ষা করছে এক অলৌকিক ঘটনার।”

উপন্যাসটির শুরুতেই ফ্রাঞ্জ ক্যাফকার একটি উদ্ধৃতি এই আশার ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে দেয়:
“তাহলে আমি অপেক্ষা করতে করতেই সেই ঘটনাটি মিস করব।”

ক্রাস্নাহরকাই নিজেও ক্যাফকার “দ্য ক্যাসল” উপন্যাসকে তাঁর অন্যতম প্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যখন আমি ক্যাফকা পড়ি না, তখন আমি তাঁর কথা ভাবি; যখন ভাবি না, তখন তাঁর চিন্তা করা আমার অভ্যাসটিকেও মিস করি।”


ওরবানকে তীব্র সমালোচনা

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের কট্টর সমালোচক ক্রাস্নাহরকাই তাঁর সরকারকে “মনোরোগের কেস” বলে আখ্যা দিয়েছেন ইউক্রেন যুদ্ধের অবস্থান নিয়ে। ওরবান কিয়েভকে সামরিক সহায়তার বিপক্ষে এবং যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার পক্ষে।

তিনি দ্য ইয়েল রিভিউ-কে বলেন, “রাশিয়া যখন প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করে, তখন কোনো দেশ কীভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারে?”

তবু খবর প্রকাশের পর ওরবান সামাজিক মাধ্যমে এক সংক্ষিপ্ত বার্তায় লেখেন,
“লাস্লো ক্রাস্নাহরকাই, হাঙ্গেরির নোবেল সাহিত্য বিজয়ী, আমাদের জাতিকে গর্বিত করেছেন। অভিনন্দন।”


স্বাধীনতার স্বাদ

ক্রাস্নাহরকাইয়ের লেখায় অনেকটাই ফুটে ওঠে ১৯৮০-এর দশকের মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতা। ১৯৮৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট শাসিত হাঙ্গেরি ছেড়ে পশ্চিম বার্লিনে চলে যান।
সেখানে তিনি পান এমন এক “গণতান্ত্রিক পরিবেশ”, যা আগে কখনো অনুভব করেননি।

তিনি বলেন, “সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমি স্বাধীনতার স্বাদ ভুলতে পারিনি।”


২১ শতকের পাঠকের জন্য অন্ধকার বাস্তবতা

লিনকন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেসন হুইটাকার বলেন, ক্রাস্নাহরকাইয়ের লেখা আজকের পাঠকদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক—বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে।

“আমরা ২০তম শতাব্দীর শেষে যে আশার পৃথিবী চেয়েছিলাম, তার বদলে ২১ শতকে প্রবেশ করেছি এক অন্ধকার ও শত্রুভাবাপন্ন সময়ে,” বলেন হুইটাকার।
“‘সাতান্তাঙ্গো’র মতো উপন্যাসের অন্ধকার রসিকতা ও নিরানন্দ বাস্তবতা এখন আরও বেশি পাঠকের মনে অনুরণন তৈরি করবে।”


চলচ্চিত্রে রূপ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ক্রাস্নাহরকাইয়ের দীর্ঘদিনের সহযোগী ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক বেলা টার। তাঁর বেশ কিছু রচনা টার চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে “সাতান্তাঙ্গো”—যার দৈর্ঘ্য সাত ঘণ্টারও বেশি—এবং “দ্য ভার্কমাইস্টার হারমোনিস”

টার বলেন, “আমি ‘সাতান্তাঙ্গো’ পড়েই বুঝেছিলাম, এর উপর ভিত্তি করে আমাকে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতেই হবে।”

১৯৯৩ সালে ক্রাস্নাহরকাই “The Melancholy of Resistance” উপন্যাসের জন্য জার্মান বেস্টেনলিস্ট পুরস্কার পান।
উপন্যাসটিতে এক ভৌতিক সার্কাসের আগমন এবং একটি বিশাল তিমির মৃতদেহকে ঘিরে নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ ফুটে ওঠে।

সুইডিশ একাডেমির মতে, “স্বপ্নময় দৃশ্য ও বিকট চরিত্রায়নের মাধ্যমে উপন্যাসটি শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার নির্মম সংঘাতকে প্রকাশ করেছে—যেখানে কেউই ভয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।”

তিনি ২০১৫ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারও জিতেছিলেন।


২০২৫ সালের চতুর্থ নোবেল পুরস্কার

সুইডিশ উদ্ভাবক ও ব্যবসায়ী আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছানুসারে ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শান্তিতে অসামান্য অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়ে আসছে।

সাহিত্য পুরস্কারজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন ফরাসি কবি সুলি প্রুডহোম (প্রথম বিজয়ী), আমেরিকান লেখক উইলিয়াম ফকনার (১৯৪৯) এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (১৯৫৩)।

গত বছর দক্ষিণ কোরীয় লেখিকা হান কাঙ এই পুরস্কার জেতেন—তিনি ছিলেন ১৮তম নারী এবং প্রথম কোরীয় যিনি এই সম্মান লাভ করেন।


(১ মার্কিন ডলার = ৯.৩৪২০ সুইডিশ ক্রোন)

রিপোর্ট: সাইমন জনসন ও ইয়োহান আহল্যান্ডার (স্টকহোম), জুস্টিনা পাভলাক (ওয়ারশ), অতিরিক্ত প্রতিবেদন: ক্রিস্তিনা থান (বুদাপেস্ট), তের্যে সলসভিক (ওসলো), গ্রেটা রোসেন ফনদান, নিক্লাস পলর্ড, মারি মানেস (স্টকহোম); সম্পাদনা: অ্যালেক্স রিচার্ডসন ও রস রাসেল


লেখক পরিচিতি

ক্রিস্তিনা থান হাঙ্গেরির চিফ করেসপন্ডেন্ট এবং সেন্ট্রাল ও ইস্টার্ন ইউরোপ ব্যুরোর ডেপুটি ব্যুরো প্রধান।
২০০৮ সালে তিনি বুদাপেস্ট ব্যুরোর প্রধান হন, যখন হাঙ্গেরি গভীর আর্থিক সংকটে ছিল।
তিনি ২০১৫ সালের অভিবাসন সংকট, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক পরিবর্তন, মুদ্রা সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন।
তিনি বুদাপেস্টের ওইটোভোস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও রুশ সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
১৯৯০-এর দশকে তিনি মস্কো, যুক্তরাষ্ট্র ও স্কটল্যান্ডে বিভিন্ন বৃত্তিতে অধ্যয়ন করেন।