ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ধরনে এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘদিন উপেক্ষার পর হঠাৎ করেই ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের প্রতি নতুন আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই ঘনিষ্ঠতা কেবল কূটনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেও নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্পর্কের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে উপেক্ষিত পাকিস্তান এখন হোয়াইট হাউসের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
২০২৫ সালের জুন মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে স্বাগত জানান। অল্প কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে, যেখানে পাকিস্তানের জন্য শুল্কহার নির্ধারিত হয় ১৯ শতাংশ — যা ভারতের উপর আরোপিত ২৫ শতাংশের চেয়েও কম।
এছাড়া, দুই দেশের কর্মকর্তারা ক্রিপ্টোকারেন্সি ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদ নিয়ে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার বিষয়েও আলোচনা চালাচ্ছেন।
পাকিস্তানের “নতুন ভাগ্য”: বিশ্লেষকের দৃষ্টিভঙ্গি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্লেষক উজায়ের ইউনুস সাম্প্রতিক এক “গ্র্যান্ড তমাশা” পডকাস্টে পাকিস্তানের এই হঠাৎ ভাগ্যবদলের পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। এই সাপ্তাহিক পডকাস্টটি হিন্দুস্তান টাইমস এবং কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস যৌথভাবে পরিচালনা করে।
উজায়ের ইউনুস বর্তমানে এশিয়া গ্রুপের অধীন তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ট্যাগ এআই-এর প্রধান প্রোডাক্ট অফিসার। এর আগে তিনি আটলান্টিক কাউন্সিলে পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ছিলেন।
তিনি পডকাস্টের উপস্থাপক মিলান বৈষ্ণবের সঙ্গে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান-নীতি পুনর্মূল্যায়ন, পাকিস্তানের খনিজসম্পদের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ এবং সামরিক “অপারেশন সিনদুর”-এর শিক্ষা বিষয়ে কথা বলেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কূটনৈতিক কৌশল
ইউনুস জানান, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাব ও সম্ভাব্য ঝুঁকি খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে। তার ভাষায়, “পাকিস্তানি নেতৃত্ব বুঝেছিল যে ট্রাম্প প্রশাসনের বিপরীত অবস্থান তাদের শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে।”
২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ একাধিক লবিং প্রচারণা চালায়, যাতে ট্রাম্প তাদের বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন বা ইমরান খান ইস্যুটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নিয়ে আসেন।
এই প্রচেষ্টাগুলির মাধ্যমে পাকিস্তান ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলকে ভালোভাবে অধ্যয়ন করে এবং অর্থনৈতিক সংযোগের সুযোগ খুঁজে বের করে — বিশেষ করে ক্রিপ্টো ও অন্যান্য কৌশলগত খাতে। ইউনুসের মতে, এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে তার কূটনৈতিক কার্ড খেলেছে।
ভারত-পাক সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার আকাঙ্ক্ষা
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বিষয়ে ইউনুস বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা থেকে সহজে সরে আসবে না। তার মতে, এই মনোভাব এসেছে ট্রাম্পের বৈশ্বিক কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে — যা একটি “পোস্ট-নিওলিবারেল বিশ্বব্যবস্থা” গঠনের ধারণায় বিশ্বাসী।
ইউনুস ব্যাখ্যা করেন, “ট্রাম্প মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং পশ্চিম গোলার্ধের বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ফলে দেশটি আর বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়ে তার শক্তি নষ্ট করতে পারে না।”
তবে তিনি সতর্ক করেন, কাশ্মীরসহ অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তান যদি বারবার সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং পারমাণবিক উত্তেজনার পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব নয়।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের প্রতি এই নতুন আগ্রহ শুধু কৌশলগত নয়, বরং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ। ট্রাম্প প্রশাসনের এই পুনর্মূল্যায়ন দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে নতুন বাস্তবতা তৈরি করতে পারে — যেখানে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকেই তাদের অবস্থান নতুনভাবে নির্ধারণ করতে হবে।