খুলনার দাকোপ ও পাইকগাছার উপকূলীয় পোল্ডার এলাকাগুলো যেন প্রতিবছর একই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি দেখছে। জোয়ারের ধাক্কায় একের পর এক বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে শত শত বিঘা জমির ধান, চিংড়ি ঘের ও বসতভিটা। বছর ঘুরে প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতি এলেও স্থায়ী সমাধান না থাকায় কৃষকদের জীবনযুদ্ধ পরিণত হচ্ছে এক অনন্ত বেদনায়।
ঢাকী নদীর ধাক্কায় দাকোপের ধানডুবি
খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়া এলাকায় ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে মঙ্গলবার রাতে মুহূর্তেই ডুবে যায় গ্রাম।
পূর্ণিমার জোয়ারে পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে শত শত বিঘা জমির আমন ধান ও অন্যান্য ফসল পানির নিচে চলে যায়। স্থানীয় কৃষকরা ভোররাত থেকে শুরু করেন স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের কাজ। কিন্তু বিকেল পর্যন্তও জোয়ারের ঢেউ থামানো যায়নি।
বটবুনিয়া গ্রামের কৃষক সঞ্জয় সদরদার বলেন, “গত বছরও একই জায়গায় বাঁধ ভেঙেছিল। এ বছর আগে থেকেই বলেছিলাম বাঁধ দুর্বল। কিন্তু মেরামত হয়নি। এখন দুই হাজার বিঘা ফসল তলিয়ে গেছে।”
দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, “৩০০ হেক্টর বা প্রায় ২ হাজার ২৩১ বিঘা জমির আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ দ্রুত ঠিক না করলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।”
দাকোপের ৩১ নম্বর পোল্ডারের অন্তর্ভুক্ত তিলডাঙ্গা ও পানখালী ইউনিয়নের বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ ষাটের দশকে তৈরি। সময়ের ক্ষয়ে দুর্বল হয়ে পড়া এসব বাঁধে এখন জোড়াতালি মেরামতই একমাত্র ভরসা।
একই বিপর্যয় কালীনগরে: পোল্ডার ২২-এর গল্প
পাইকগাছা উপজেলার কালীনগর এলাকা, ২২ নম্বর পোল্ডার—নদীর ধারে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই জীবনই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
গত আগস্টে এখানকার বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় প্রায় ১৪টি গ্রাম। সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, কালীনগর, হরিণখোলা, ফুলবাড়ী, গোপিপাগলা, সায়েদখালি ও দারুণমল্লিকসহ বিভিন্ন গ্রাম পানিতে তলিয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল গাজী বলেন, “বাঁধটা ভাঙে রাতে। জোয়ারের সময় পানি এসে সব ঘর তলিয়ে দেয়। আমরা সবাই উঠে যাই রাস্তার ওপর।”
পাইকগাছা পাউবোর এক প্রকৌশলী বলেন, নদীর প্রবল স্রোতে বাঁধের নিচের জিও ব্যাগগুলো ভেসে গেছে, ফলে পুরো অংশ ধসে পড়ে। স্থানীয়দের সহায়তায় মেরামতের চেষ্টা চলছে, তবে স্থায়ী সমাধান ছাড়া এই বিপর্যয় থামানো যাবে না।
এভাবে খুলনার দুই প্রান্ত—দাকোপ ও পাইকগাছা—প্রায় একই সময়, একই রকম দুর্যোগের মুখোমুখি হয়।
এ যেন এক পুনরাবৃত্ত দুর্যোগের চক্র, যেখানে নদীর জোয়ার ও সরকারি উদাসীনতা একত্রে ধ্বংস করে দিচ্ছে কৃষকের বছরভর পরিশ্রম।
কেন বারবার ভাঙছে বাঁধ?
দুর্বল ও পুরনো অবকাঠামো
বেশিরভাগ বাঁধ ষাটের দশকে তৈরি এবং বছরের পর বছর জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়। জিও ব্যাগ, মাটি, বাঁশ দিয়ে তৈরি সাময়িক মেরামত কয়েক মাসের মধ্যেই আবার ধসে পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিরিক্ত জোয়ার
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রবল জোয়ার ও উজানের পানি ঢল এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। নদীর তলদেশে সিলট জমে প্রবাহের দিকও বদলে গেছে, ফলে বাঁধের নিচে তীব্র ক্ষয় সৃষ্টি হয়।
প্রকল্পের বিলম্ব ও দুর্বল বাস্তবায়ন
৩১ নম্বর পোল্ডারে জাইকার অর্থায়নে ৩,৭৫০ মিটার স্থায়ী নদীশাসন প্রকল্পের প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠানো হলেও এখনো অনুমোদন হয়নি।
পাইকগাছার পোল্ডার ২২–এর ক্ষেত্রেও ব্লু-গোল্ড প্রকল্পের নকশা শেষ হলেও বাস্তবায়ন বিলম্বিত।
স্থানীয় প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা
পাউবো ও ইউনিয়ন পরিষদের কর্মীসংখ্যা সীমিত; ফলে নিয়মিত মনিটরিং হয় না।
ভাঙন দেখা দিলেও বাজেট অনুমোদন ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সময় লেগে যায়—এই সময়ের মধ্যেই পুরো বাঁধ ভেঙে পড়ে।
ক্ষতির হিসাব
দাকোপে প্লাবিত ফসলের পরিমাণ: প্রায় ৩০০ হেক্টর আমন ধান
পাইকগাছায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা: ১৪টি গ্রাম, প্রায় ১৫ হাজার মানুষ
আনুমানিক ক্ষতি: কোটি টাকারও বেশি কৃষিপণ্য, মাছের ঘের ও বসতভিটা ধ্বংস
স্থানীয় কৃষক মনিরুল ইসলাম বলেন, “আমরা সরকারে আবেদন করি, পাউবো অফিসে যাই, কিন্তু কাজ হয় না। ফসল গেল, চিংড়ি গেল—এখন জীবনই অনিশ্চিত।”
ভবিষ্যতের করণীয়
টেকসই বাঁধ নির্মাণ
স্থায়ী বাঁধে পাইলড্রাইভিং, কংক্রিট স্ল্যাব ও সঠিক উচ্চতা নির্ধারণ করতে হবে।
বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল
প্রতিটি পোল্ডারে স্থানীয় পর্যায়ে বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট বরাদ্দ।
বন্যা-প্রতিরোধ মানচিত্র
নদীর জোয়ার, স্রোত ও মাটি ক্ষয়ের মানচিত্র তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ধারণ।
স্থানীয় জনবল প্রশিক্ষণ
স্বেচ্ছাশ্রমী দলকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও জরুরি সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।
প্রকল্প অনুমোদনের গতি বৃদ্ধি
দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
দাকোপ থেকে কালীনগর—দুই জায়গার গল্প এক, শুধু তারিখ বদলায়। নদীর ভাঙন, কৃষকের কান্না, আর প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি—সবই যেন একটি পুনরাবৃত্ত নাটক।
যদি এখনই স্থায়ী বাঁধ, টেকসই পরিকল্পনা ও স্থানীয় জনগণের নেতৃত্বে কাজ না হয়, তাহলে আগামী মৌসুমে আবারও একই দৃশ্য দেখা যাবে—বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেল হাজার বিঘার আমন।
#দাকোপ #কালীনগর #পোল্ডার২২ #হরিণখোলা #দারুণমল্লিক #বাঁধভাঙন #খুলনাবিপর্যয় #নদীভাঙন #কৃষকজীবন #সারাক্ষণরিপোর্ট