ভারতের শেয়ারবাজারে এখন চলছে তহবিল সংগ্রহের নজিরবিহীন মৌসুম। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ৭৯টি কোম্পানি প্রায় ১১.৫ বিলিয়ন ডলার তুলেছে প্রাথমিক শেয়ার বিক্রির (IPO) মাধ্যমে। বছরের শেষ তিন মাসে আরও ১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের সম্ভাবনা থাকায়, ভারত এই বছর মোট ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আইপিও তহবিল সংগ্রহ করতে যাচ্ছে—যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
আইপিওর পেছনে বিনিয়োগ জোয়ার
বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা, বাণিজ্য যুদ্ধ বা মার্কিন শুল্কবৃদ্ধি—কিছুই থামাতে পারেনি ভারতের আইপিও উচ্ছ্বাস। উইওয়ার্ক ইন্ডিয়া, এলজি ইলেকট্রনিকস ইন্ডিয়া, টাটা ক্যাপিটালসহ বহু বৃহৎ প্রতিষ্ঠান একের পর এক নতুন শেয়ার বাজারে এনে তুলেছে বিপুল অর্থ।
বিনিয়োগ ব্যাংক ‘কোটাক মহিন্দ্রা ক্যাপিটাল কোম্পানির’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভি জয়শঙ্কর বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এখন নিয়মিত মিউচুয়াল ফান্ডে মাসিক বিনিয়োগ করছে। এই প্রবাহই আইপিও বাজারকে শক্ত রেখেছে।”
নতুন যুগের কোম্পানিগুলোর উত্থান
‘জে.পি. মরগান’-এর ভারতের ইক্যুইটি ক্যাপিটাল মার্কেটস প্রধান অভিনব ভারতি মনে করেন, “গত দশকের প্রবৃদ্ধি ভারতের ভেতরে বহু পরিণত কোম্পানি তৈরি করেছে। এটি কেবল শুরু। ভবিষ্যতে ভারত নিয়মিতভাবে ২০ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি আইপিও বাজার বজায় রাখতে পারবে।”
নতুন যুগের প্রযুক্তি, ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা, খুচরা ও অবকাঠামো খাতের কোম্পানিগুলো এখন শেয়ারবাজারে প্রবেশ করছে—যা বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ তৈরি করছে।
উচ্ছ্বাসের মধ্যেও সতর্কতার বার্তা
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এই “বিনিয়োগ উৎসব”-এর পেছনে অতি-আশাবাদ লুকিয়ে আছে।
‘ওয়েলথমিলস সিকিউরিটিজ’-এর বিশ্লেষক ক্রান্তি বাথিনি বলেন, “বাজারে এখন অনেক উচ্ছ্বাস। বিনিয়োগকারীদের উচিত প্রতিটি কোম্পানির আর্থিক বিবরণ ভালোভাবে যাচাই করা। অন্ধভাবে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি বাড়বে।”
বাজারে মিশ্র ফলাফল
যদিও আইপিও বাজার উত্তপ্ত, ভারতের মূল সূচক নিফটি-৫০-এ বছর মাত্র ৬% প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, আর ছোট ও মাঝারি কোম্পানির সূচকগুলো নেতিবাচক রিটার্ন দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চ শেয়ারমূল্য, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতের ওপর ৫০% শুল্ক আরোপের প্রভাব বাজারে চাপ তৈরি করছে।
বিদ্রূপের বিষয়, এসব শঙ্কাই আবার নতুন আইপিওর প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছে। জয়শঙ্কর বলেন, “অনেকে মনে করছে, নতুন তালিকাভুক্ত শেয়ারে ১৫–২০% তাৎক্ষণিক লাভের সম্ভাবনা বেশি।”
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন—এই বছর তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর অর্ধেকই এখন তাদের প্রাথমিক মূল্যের নিচে লেনদেন করছে। কোটাকের তথ্য অনুযায়ী, ৭৯টির মধ্যে মাত্র ৪৩টি কোম্পানি ইতিবাচক রিটার্ন দিয়েছে।
ক্ষুদ্র কোম্পানির অস্থিরতা
বছরের প্রথমার্ধে বাজারে আসা কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগই ক্ষুদ্র পরিসরের, যেগুলো সাধারণত বেশি অস্থির।
জয়শঙ্কর বলেন, “বছরের শেষ প্রান্তিকে সাধারণত বড় ও উচ্চমানের কোম্পানিগুলো আইপিও আনে—তখন বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে।”
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ
দেশের ভেতরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিপরীত পথে হাঁটছে। তারা এ বছর ভারতের শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার তুলে নিয়েছে।
ক্রান্তি বাথিনি বলেন, “বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এখন অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণের কৌশল নিচ্ছে। এক সময় ভারত ছিল তাদের সবচেয়ে প্রিয় বাজার, কিন্তু কয়েক মাসেই তা সবচেয়ে কম পছন্দের দেশে পরিণত হয়েছে—মূলত শুল্ক ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে।”
দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আবেগ বনাম বাস্তবতা
অর্থনীতিবিদ বিবেক কৌল তাঁর বিশ্লেষণে লিখেছেন, “একটি সম্পূর্ণ শিল্প এখন এই ‘বিনিয়োগ-উচ্ছ্বাস’ ধরে রাখার জন্য কাজ করছে—যার মধ্যে রয়েছেন বিনিয়োগ ব্যাংকার, ব্রোকারেজ বিশ্লেষকরা ও ফান্ড ম্যানেজাররা।”
তিনি আরও বলেন, “এই উন্মাদনা হয়তো মজার, কিন্তু এটি টেকসই আর্থিক নিরাপত্তার পথ নয়।”
সামনে কী?
তবুও ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা থামছেন না। আগামী মাসগুলোতে ওয়ালমার্ট-সমর্থিত ফোনপে, জিও, গ্রো, মিশোর মতো বড় কোম্পানিগুলো আইপিও বাজারে আসছে।
ফলে, ভারতের এই “আইপিও পার্টি” আরও কিছু সময় চলবে বলেই মনে করছেন বাজার-বিশ্লেষকরা।
ভারতের শেয়ারবাজারের এই নতুন অধ্যায় একদিকে প্রবৃদ্ধির প্রতীক, অন্যদিকে তা এক ধরনের ঝুঁকির ইঙ্গিতও। দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আবেগ ও আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তার মাঝে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়াই এখন ভারতের মূল চ্যালেঞ্জ।
#ভারত #আইপিও #শেয়ারবাজার #বিনিয়োগ #অর্থনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট #ফান্ডরেইজিং #টাটাক্যাপিটাল #এলজিইলেকট্রনিকস #উইওয়ার্কইন্ডিয়া #বিবিসিনিউজ