দুই বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত নতুন চুক্তি গাজা যুদ্ধের অবসানের আশা জাগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সম্পন্ন এই সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নতুন বার্তা বহন করলেও, অনেক বিশ্লেষক এখনো সতর্ক আশাবাদী অবস্থান নিয়েছেন।
নতুন চুক্তিতে আশার আলো
ওয়াশিংটন থেকে গাজা পর্যন্ত এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এক প্রশ্ন—“গাজা যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ?”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে হওয়া নতুন চুক্তি “একটি স্থায়ী ও টেকসই শান্তির প্রথম ধাপ”।
দুই বছর ধরে চলা গাজার যুদ্ধের অবসানে এটি হতে পারে এক বড় মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
তবে এই চুক্তি আপাতত শুধুই প্রাথমিক ধাপ। এতে রয়েছে যুদ্ধবিরতি, গাজায় আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের বিনিময়ে ইসরায়েলে বন্দি ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মুক্তি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর আংশিক প্রত্যাহার।
শার্ম আল-শেখে স্বাক্ষরিত সমঝোতা
চুক্তিটি মিশরের শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত এক পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয়—যা বহু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি উদ্যোগের ঐতিহাসিক ভেন্যু হিসেবে পরিচিত।
তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এখানকার সমঝোতাগুলোর সফলতার হার সব সময়ই মিশ্র।
এবারের চুক্তি আলাদা, কারণ এতে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত হয়নি। আগের যুদ্ধবিরতির মতো “কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ব্যর্থ হলে লড়াই আবার শুরু”—এমন শর্ত এখানে নেই। এটি এক অনির্দিষ্ট সময়ের শান্তি প্রক্রিয়া, যা টিকে থাকলে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা আরও জোরালো হবে।
বোমাবর্ষণ বন্ধ হয়নি পুরোপুরি
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরও পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত হয়নি। ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা আংশিকভাবে গৃহীত হলেও, ইসরায়েল গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করেনি।
গত কয়েক দিনে বিশেষ করে গাজা সিটি ও আশপাশের এলাকায় বহু ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।
তবে বুধবার ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি ঘোষণার পর থেকে ইসরায়েলি হামলা তুলনামূলকভাবে কমেছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে—চলমান প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও কার্যকর হতে শুরু করেছে।
ইসরায়েলি রাজনীতির অভ্যন্তরীণ চাপ
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় চুক্তিটি মেনে নিয়েছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা, যুদ্ধক্লান্ত জনগণের সমর্থন অর্জন এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী জোটের বিরাগ এড়িয়ে চলা—সব মিলিয়ে তিনি এখন ভারসাম্যের রাজনীতিতে রয়েছেন।
তবে তাঁর জোটের অনেকেই এখনও “যুদ্ধ শেষ নয়”—এই অবস্থান নিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ সরাসরি বলেছেন, “জিম্মিদের ফেরত পাওয়ার পর হামাসকে ধ্বংস করতে হবে।”
হামাসের অবস্থান পরিবর্তন
হামাস দীর্ঘদিন ধরে “আংশিক চুক্তি”-র বিরোধিতা করে আসছিল, কারণ এতে জিম্মি ফেরত দেওয়ার পর যুদ্ধ আবার শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এবার তারা সেই অবস্থান বদলেছে।
চুক্তিতে প্রথমবারের মতো “গাজা নিরস্ত্রীকরণ” বিষয়েও হামাস রাজি হয়েছে—যা আগে তারা বারবার প্রত্যাখ্যান করেছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান, আরব রাষ্ট্র ও তুরস্কের চাপ—সব মিলিয়ে হামাসের সামনে চুক্তি মানা ছাড়া বিকল্প ছিল না।
এখন তাদের কৌশল হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে অন্তত সাময়িকভাবে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হবে না—এই নিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করা।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী
নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, চুক্তিটি বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পর কার্যকর হবে।
এক সূত্রের মতে, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি সেনারা গাজা থেকে পিছু হটবে।
এছাড়া ট্রাম্পের পরিকল্পনায় রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী গঠন, যা ইউরোপীয় ও আরব রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণে গঠিত হবে।
প্যারিসে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা। আলোচনায় থাকবে গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা, পুনর্গঠন এবং সহায়তা তহবিলের কাঠামো।
সতর্ক আশাবাদ
চুক্তি কার্যকর হলে এটি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ায় এক নতুন অধ্যায় খুলে দিতে পারে।
তবে অতীতের অভিজ্ঞতা দেখায়—অতি আশাবাদী হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
গাজা ও ইসরায়েল উভয় পক্ষের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এখনো রয়ে গেছে।
তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, “এটি হয়তো যুদ্ধের অবসান নয়, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিরতি—যা থেকে স্থায়ী শান্তির ভিত্তি তৈরি হতে পারে।”
#গাজাযুদ্ধ #ইসরায়েলহামাসচুক্তি #মধ্যপ্রাচ্যশান্তি #ট্রাম্পসমঝোতা #সারাক্ষণরিপোর্ট #গাজাসংঘাত #WarAndPeace #PeaceDeal