বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনকে ‘একপেশে’ ও ‘অস্বচ্ছ’ আখ্যা দিয়ে ৪০টিরও বেশি ক্লাব ক্রিকেট বর্জন করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে করে দেশের ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও সদ্য নির্বাচিত বোর্ড প্রেসিডেন্ট আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলছেন, দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান করবে বোর্ড।
তবে নির্বাচনের আগে থেকেই এই নির্বাচনকে ঘিরে ছিল নানা প্রশ্ন এবং শেষ পর্যন্ত একটা পক্ষ সরে দাঁড়ানোর পরে এই নির্বাচন কতোটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন সাবেক ক্রিকেটার ও ক্লাবগুলোর সাথে সম্পৃক্তরা।
এর আগে ৬ই অক্টোবর, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচন প্রত্যাশিতভাবেই কোনো চমক ছাড়াই শেষ হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল যেন ছিল আগেই নির্ধারিত, ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরিচালনা পর্ষদের ২৫ জন সদস্য নির্বাচিত হন।
এরপর তাঁদের ভোটে আমিনুল ইসলাম আবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিসিবির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
একই নির্বাচনে ফারুক আহমেদ ও শাখাওয়াত হোসেন সহ-সভাপতি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।
ফলাফল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে আমিনুল ইসলামকে নতুন সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই ক্রিকেট অঙ্গনে ধারণা ছিল, বিসিবির এই নির্বাচনও আগের মতোই হবে ‘অনুমিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন’। তাই অনেকের চোখে এবারের ফলাফলও ছিল কেবল আনুষ্ঠানিকতা পূরণ।
এর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনকে আগে থেকেই ‘ঠিক করা’ ছিল- এমন অভিযোগ তুলে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালসহ ১৬ জন প্রার্থী।
কাউন্সিলরদের ও বিসিবির অবস্থান কী?
মেজর অবসরপ্রাপ্ত ইমরোজ আহমেদ কলাবাগান ক্রিসেন্ট ক্লাবের কাউন্সিলর, তিনি বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তারা ক্লাবে ফেরত যাবেন সমষ্টিগত একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সব ক্লাব একসাথে বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তিনি যোগ করেন, “তবে আমরা এখানে গদির জন্য আসিনি, গদি ছাড়াই আমরা কাজ করেছি ২০০৩ সাল থেকে। একটা কথাই বলতে চাই নির্বাচন ঠিক হয়নি, যেভাবে নির্বাচন হয়েছে, তা আমরা মেনে নিতে পারি না, এখানে সরকার একটা প্রভাব বিস্তার করেছে।”
তিনি দাবি করেছেন, “অনেকে আছেন কাউন্সিলর নন, তবু এখন বিসিবিতে আসছেন। ক্রিকেটের সাথে কখনো ছিলেন না, এখন বিসিবিতে পদ পাচ্ছেন।”
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের যে নির্বাচনি আইন আছে, সেটা মানা হয়নি বলে দাবি করেছেন ইমরোজ আহমেদ, তার দাবি, “পুরো বিষয়টাকেই এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে একটা পক্ষই আসে”।
তিনি বলেন, “আমি অন্তত চারজনের কথা বলতে পারি যে ভোট দেইনি, তাহলে কারা ভোট দিলো। ৪২ জন যারা ভোট দিয়েছেন তাদের নাম প্রকাশ করেন আমরা তাহলে কল দিয়ে কথা বলবো।”
ক্লাব ও বিসিবির অবস্থান যদি এমনই থাকে, তবে একটা অচলাবস্থা তৈরি হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে, ইমরোজ আহমেদ বলছেন এমনটা কাম্য নয়।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মকর্তা মাসুদুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসনে বহু বিতর্কিত নির্বাচন তিনি দেখেছেন, তবে এবারের ভোট যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনেনি। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সামনের সব প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করব।”
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক নাজমুল আবেদিন ফাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, কারো ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা ভাবনা থাকতে পারে। কিন্তু সেটার প্রভাব ক্রিকেটে পড়তে দেয়া হবে না, ইতোমধ্যে ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস- সিসিডিএম থেকে বলা হয়েছে সব ক্লাবকে সঙ্গে নিয়ে লীগ চালাবে।
নাজমুল আবেদিন ফাহিম সবশেষ নির্বাচনেও পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি ক্রিকেট অপারেশন্সের দায়িত্ব পেয়েছেন আবারো।
ঢাকা মহানগর ক্রিকেট কমিটি (সিসিডিএম) জানিয়েছে, তারা ২০২৫–২৬ মৌসুমের নির্ধারিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঢাকায় ক্লাবভিত্তিক সব লিগ আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানায়, খেলোয়াড় ও সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগ, প্রথম বিভাগ টি-টোয়েন্টি লিগ, তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগ এবং সিসিডিএম চ্যালেঞ্জ কাপ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, খেলোয়াড়দের কল্যাণই বিসিবি ও সিসিডিএম-এর মূল অগ্রাধিকার।
এমন পরিস্থিতিতে আইসিসির কোনো ভূমিকা থাকতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মি ফাহিম জানান, “আইসিসি গভর্নিং বডি হিসেবে হয়তো চোখ রাখবে পরিস্থিতির দিকে, তবে এটা একটা অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে কোনো হস্তক্ষেপ বা ভূমিকা থাকবে না আইসিসির।”
নাজমুল আবেদিন ফাহিম আরও জানান, “যার যার ডিপার্টমেন্ট থেকে যথাযথভাবে কাজ করতে ক্রিকেট আবার সঠিক পথে আসবে, ক্রিকেট অপারেশন্সে কাজ আছে জাতীয় দল কীভাবে ভালো খেলে সেটা নিশ্চিত করা। খেলা মনিটর করা। এই বিভাগের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করে এনসিএল লিস্ট এ কেমন হচ্ছে সেটার ওপর।”
নারী ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি জানান, এই দলটাকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে যা যা করণীয় সব করবে এই বোর্ড।

তামিম ইকবাল ও আমিনুল ইসলাম বুলবুল কী বলছেন?
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনের আগে দেশত্যাগ করেছিলেন তামিম ইকবাল, এরপর নির্বাচনের পর দেশে ফিরে আবারও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন সাবেক এই অধিনায়ক, সাথে ছিলেম কয়েকজন ক্রিকেট সংগঠক।
বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, নির্বাচনটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়নি এবং ভোট প্রক্রিয়ায় নানা অসঙ্গতি ছিল। তামিম অভিযোগ করেন, তিনি বিদেশে থাকায় ই-ভোটের আবেদন করলেও পরে জানতে পারেন তাঁর ভোট কাস্ট হয়নি। তবুও দেখা যায়, নির্বাচনে উপস্থিত অনেকেই ই-ভোট দিয়েছেন, যা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
তামিম দাবি করেন, স্বচ্ছ নির্বাচন হলে তিনিও সহজেই জিততেন, কিন্তু নির্বাচনটি ছিল ‘নির্ধারিত ও অনিয়মে ভরা’।
সংগঠকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা এই নির্বাচন মেনে নিচ্ছেন না এবং ঢাকার প্রিমিয়ার লিগসহ সব পর্যায়ের ক্রিকেট কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেট সাংবাদিক বর্ষন কবির বলেন, “বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের যে নির্বাচন হয়েছে সেটা ভবিষ্যতের জন্য একটা বাজে রেফারেন্স হিসেবে থেকে যাবে।”
তিনি যোগ করেন, “আপাতত কাগজে কলমে হয়তো বিসিবি এই নির্বাচন ও এর প্রক্রিয়াকে আইনসিদ্ধ বলে দাবি করতে পারে কিন্তু এর মাঝেও থেকে গেছে কিছু অনিয়ম, যা আমাদের নজরে এসেছে। যেমন ঢাকার দুটি হোটেলে থেকে কাউন্সিলররা ই-ভোট দিয়েছেন যা একেবারেই নিয়মবহির্ভুত।”
তবে বিসিবির নবনির্বাচিত সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নে বোর্ডের ভেতরে-বাইরে থাকা সব স্টেকহোল্ডারদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বুলবুল বলেন, “আমরা চাই সবাই মিলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করতে। কে বোর্ডে আছে বা নেই, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা সবাইকে আহ্বান জানাব একসঙ্গে এগিয়ে যেতে। প্রয়োজনে আমরা নিজেরাই তাদের কাছে যাব, যেন সবাই মিলে দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে পারি।”
নির্বাচন সঠিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে কি না, এই সিদ্ধান্ত কমিশনের বলছেন তিনি।
সাংবাদিক বর্ষণ কবির বলেন, “এমন একটা নির্বাচনে আমিনুল ইসলাম বুলবুল নির্বাচিত হলেন যে তার নাম থেকে যাবে, একই সাথে ক্রীড়া উপদেষ্টার নামও থেকে যাবে। এটা ভালো কোনও উদাহরণ হিসেবে মানুষ মনে রাখবে না।”

ক্লাবগুলোর ক্রিক্রেট বর্জনের নেপথ্যে
ঢাকার ক্লাব ক্যাটাগরি যেটাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নির্বাচনে বি ক্যাটাগরি ধরা হয় সেখান থেকে ১২ জন পরিচালক নির্বাচিত হন, যারা দেশের ক্লাব ক্রিকেটের সংগঠক।
সাংবাদিক মাজহারুল ইসলাম বলেন, এসব নির্বাচনে সাধারণত তারাই এগিয়ে থাকেন যারা ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ক্লাবের প্রার্থী। তবে এবারে সমস্যা হয়েছে যখন দেখা গেছে কোনও দলই একচেটিয়া ক্ষমতায় নেই।
এখানেই ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার ভূমিকার কথা চলে আসে, বিশেষত নির্বাচনের পরে তিনি একটি ফেসবুক পোষ্ট দিয়ে জানিয়েছেন, ‘ধৈর্য্য ধরলে অনেকেই বোর্ড পরিচালক হতে পারতেন’।
এই প্রেক্ষিতে তামিম ইকবাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচনে দাঁড়ালে তিনি যে নির্বাচিত হতেন তাতে সন্দেহ নেই, তবে নির্বাচনটা যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তাতে তিনি খুশি নন, তাই সরে দাঁড়িয়েছেন।
মাজহারুল ইসলাম বলেন, ক্রীড়া উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের মধ্যে একটা বোঝাপড়া চলছিল যা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি, যে কারণে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেছে।
বিশেষত ক্লাব কাউন্সিলরদের কথা উল্লেখ করে মি. ইসলাম বলেন, “এই সংগঠকরা বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্লাবগুলোতে টাকা ঢালেন বোর্ডে আসার জন্য, শেষ পর্যন্ত ক্লাব কাউন্সিলররা যদি পরিচালক হতে না পারে তারা কেন এখানে টাকা ঢালবে।”
সংগঠকদের অভিযোগ ক্রীড়া উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে এই ক্লাবগুলো থেকে পরিচালক আসেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মনমালিন্যের ফল ভোগ করতে হবে ক্রিকেটারদের।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক ক্লাব সংগঠকই দেশ ত্যাগ করেছেন, তাদের অধীনে যে ক্লাবগুলো ছিল সেখানে করুণ দশা। আগের মৌসুমে যে ক্রিকেটার ২০ লাখ টাকায় খেলেছেন এবারে খেলেছেন ২ লাখ টাকায়।
অর্থাৎ যে অর্থ ব্যয় করা হতো সেখান থেকে সরে আসছে ক্লাবগুলো।
মাজহারুল ইসলাম মনে করেন, “পুরো প্রক্রিয়া আসলে ক্রিকেটারদের ওপরই প্রভাব পড়বে। জানা যাচ্ছে, ক্রিকেট বর্জনের এই সিদ্ধান্ত থেকে ক্লাব গুলো সরে আসতে চায় না”।
বিবিসি বাংলা