মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফোন কূটনীতি, কাতার আক্রমণে তাঁর ভূমিকা এবং ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধ–পরবর্তী অবস্থান হামাসের সিদ্ধান্তকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। গাজার বন্দীদের মুক্তি দিয়ে হামাস এক ঝুঁকিপূর্ণ বাজি খেলেছে—তাদের বিশ্বাস, ট্রাম্প হয়তো ইসরায়েলকে শান্তি চুক্তিতে বাধ্য করতে পারবেন।
সারাংশ
- ট্রাম্প তিনবার ফোনে সরাসরি মধ্যস্থতা করেন: মার্কিন সূত্র
- কাতার আক্রমণ ও ইরান–যুদ্ধে ট্রাম্পের ভূমিকা হামাসের আস্থা বাড়ায়
- লিখিত কোনো গ্যারান্টি নেই, তবু হামাস মৌখিক আশ্বাসে রাজি
ট্রাম্প এবং ফোন কূটনীতি
হামাস একসময় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বর্ণবাদের প্রবণ, “উল্টো-পাল্টা পরিকল্পনাবাদী” এবং গাজা সম্পর্কে অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী বলেছিল। কিন্তু গত মাসে এক অস্বাভাবিক ফোনকলে তারা বুঝতে পারে—ট্রাম্প হয়তো ইসরায়েলকে শান্তি চুক্তিতে বাধ্য করতে পারেন, এমনকি হামাস যদি সব বন্দীও মুক্ত করে দেয়।
যে ফোনকলটি তখন ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল, সেটির পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এক বৈঠকের শেষে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন এবং কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে কাতারে আক্রমণের জন্য ক্ষমা চান। ওই আক্রমণে হামাস নেতারা যে আবাসিক কমপ্লেক্সে ছিলেন, সেটি লকডাউন করা হয়েছিল।
এই পদক্ষেপ—যদিও হামাস নেতাদের (যেমন প্রধান আলোচক খলিল আল–হায়া) হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল—হামাসকে আরও বিশ্বাস দেয় যে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম এবং গাজার যুদ্ধ শেষ করতে আন্তরিক।
যুদ্ধবিরতির শর্ত ও যুদ্ধ–পরবর্তী অগ্রাধিকার
শুক্রবার থেকে কার্যকর হওয়া এই চুক্তিতে হামাস বন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে, যদিও ইসরায়েলের পূর্ণ প্রত্যাহারের কোনো শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল না। হামাসের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এটি এক ঝুঁকিপূর্ণ বাজি—তারা বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প এটি ব্যর্থ হতে দেবেন না।
হামাসের মধ্যে আশঙ্কা আছে, একবার বন্দীরা মুক্ত হলে ইসরায়েল আবার যুদ্ধ অভিযান শুরু করতে পারে—যেমন জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির পর হয়েছিল।
তবে শারম আল–শেখের রেড সি রিসোর্টে ইসরায়েলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরোক্ষ আলোচনায় ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও আঞ্চলিক প্রভাবশালী নেতাদের উপস্থিতিতে হামাস কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। যদিও তাদের প্রধান দাবি—একটি পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন—এখনো অনির্ধারিত রয়ে গেছে।
এক হামাস কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, “ট্রাম্পের আগ্রহ সেই সম্মেলনকেন্দ্রে গভীরভাবে অনুভব করা গিয়েছিল।” মারাথন আলোচনার সময় ট্রাম্প নিজে তিনবার ফোন করেছিলেন, আর তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনার ও ব্যবসায়ী উপদেষ্টা স্টিভ উইটকফ ইসরায়েলি ও কাতারি মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে সমন্বয় করছিলেন।
ভবিষ্যতের ধাপ — অনিশ্চয়তা ও প্রত্যাশা
এই যুদ্ধবিরতির ধাপ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাস–ইসরায়েল সংঘাতের অবসান ঘটানোর সম্ভাবনা জাগিয়েছে। তবে ট্রাম্পের ২০–দফা গাজা পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলো বাস্তবায়িত হবে কিনা, সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কাতার আক্রমণ ও জুনের ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধের শেষে ট্রাম্পের ভূমিকা হামাস আলোচকদের মধ্যে বিশ্বাস বাড়িয়েছে যে, যুদ্ধবিরতি টেকসই থাকবে এবং ইসরায়েল পুনরায় যুদ্ধ শুরু করবে না।
ট্রাম্পের সহযোগীরা নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ দেখেছিলেন—যা তৈরি হয়েছিল কাতারে ট্রাম্পের ক্ষোভের মাধ্যমে।
ট্রাম্প, যিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করেছেন, কাতারের আমিরকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করেন এবং টেলিভিশনে কাতারে আক্রমণের দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ হন। হোয়াইট হাউসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “এই আক্রমণটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যা আরব বিশ্বকে একত্রিত করেছে।”
ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি—ভবিষ্যতে কাতারের দিকে আর কোনো ইসরায়েলি আক্রমণ হবে না—হামাস ও মধ্যস্থতাকারীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।
গাজার এক কর্মকর্তা আরও জানান, ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ইরান–ইসরায়েল শত্রুতা বন্ধের আহ্বান জানান এবং ইসরায়েলি বিমানগুলোকে ‘ফিরে যাও’ নির্দেশ দেন। যদিও এই বক্তব্য নাটকীয় মনে হয়েছে, তবু ট্রাম্পের কথাকে তিনি কার্যকর করার প্রবণতা রাখেন বলেই হামাসে এর প্রভাব পড়েছে।
আলোচনায় অগ্রগতি ও স্থবিরতা
প্রধান পরিকল্পনাটি ২৯ সেপ্টেম্বর নেতানিয়াহুর হোয়াইট হাউস সফরে ঘোষণা করা হয়, এবং চার দিনের মধ্যেই হামাস আংশিকভাবে সেটি মেনে নেয়—যা ট্রাম্পের কাছে সবুজ সংকেত হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
তবে আলোচনা এক পর্যায়ে স্থবির হয়ে পড়ে। ইসরায়েল কত দ্রুত গাজা থেকে সরে যাবে এবং কতটা সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখবে—এ নিয়েই জট তৈরি হয়। কাতার, মিশর ও তুরস্কের মধ্যস্থতায়ও তা এগোচ্ছিল না।
অচলাবস্থা দূর করতে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল–থানি শারম আল–শেখে আসেন। একই সঙ্গে উইটকফ ও কুশনারও সেখানে পৌঁছান, এবং বুধবার দুপুরে নতুন আলোচনার সূচনা হয়।
তুরস্কের গোয়েন্দা প্রধান ইব্রাহিম কালিনের উপস্থিতিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তুরস্কের সঙ্গে হামাস ও এরদোয়ানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এরদোয়ান ট্রাম্পকে জানান, তিনি হামাসকে পরিকল্পনায় রাজি করাতে ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহিত করেছেন।
দুই বছর ধরে হামাস বলে আসছে—তারা বন্দীদের মুক্তি দেবে কেবল তখনই, যখন সব ইসরায়েলি সৈন্য গাজা থেকে সরে যাবে। ইসরায়েল বলেছে, যুদ্ধ তখনই শেষ হবে, যখন সব বন্দী ফিরে আসবে এবং হামাস নিরস্ত্র হবে।
কোনো পক্ষই পুরোপুরি জয়লাভ করতে পারেনি। বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী, ইসরায়েল গাজার প্রায় অর্ধেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাখবে, হামাস প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকবে, এবং অস্ত্র ত্যাগের ইস্যুটি ভবিষ্যতের আলোচনায় রাখা হয়েছে।
এই পারস্পরিক গতিশীলতা—যেখানে উভয় পক্ষই ফলাফল চায়—ভবিষ্যৎ আলোচনার অগ্রগতিতে সহায়ক হতে পারে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, মধ্যস্থতাকারীরা হামাসকে বোঝাতে পেরেছেন যে বন্দীদের ধরে রাখা এখন তাদের জন্য একপ্রকার বোঝা। হামাস বুঝেছে, বন্দী ধরে রাখলে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি কমে যাবে এবং বন্দীদের মুক্তি ছাড়া ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি মানবে না।
তবে কোনো লিখিত গ্যারান্টি নেই—যা নিশ্চিত করবে যে প্রথম ধাপ (বন্দী মুক্তি, ইসরায়েলের আংশিক প্রত্যাহার ও যুদ্ধবিরতি) ভবিষ্যতের বৃহত্তর চুক্তিতে রূপ নেবে। হামাস যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যস্থতাকারীদের মৌখিক আশ্বাসেই সন্তুষ্ট থেকেছে যে, ট্রাম্প চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন।
এক হামাস কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের জন্য এই চুক্তি যুদ্ধের অবসান ঘটায়।”
জাঁকজমক, ভয় ও সম্ভাব্য বিপর্যয়
হামাস নেতারা খুব ভালোভাবেই জানেন, তাদের এই বাজি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
গত জানুয়ারিতে ধাপে ধাপে বন্দী মুক্তি ও ইসরায়েলি প্রত্যাহারের মধ্যেই ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন—“সব বন্দী একসঙ্গে মুক্ত করতে হবে, নয়তো চুক্তি বাতিল।” পরে সেই চুক্তি ভেঙে যায়। পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, পরবর্তী সংঘাতে ১৬,০০০–এর বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান এবং ইসরায়েল জরুরি সহায়তা বন্ধ করে দেয়, যার ফলে গাজায় খাদ্যাভাব দেখা দেয় ও দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হয়।
এক আঞ্চলিক কূটনীতিক জানান, ইসরায়েল আবারও হামাসকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাতে পারে, বিশেষ করে যদি হামাস বা তার সহযোগীরা রকেট নিক্ষেপের মতো হামলা করে।
তবে বর্তমানে পরিস্থিতি আগের যুদ্ধবিরতির তুলনায় ভিন্ন। হামাস বুঝেছে, ইসরায়েল এবার চুক্তি করতে সত্যিই আগ্রহী; মধ্যস্থতাকারী দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপও কার্যকর হচ্ছে।
ট্রাম্পের সম্ভাব্য মধ্যপ্রাচ্য সফর—এক প্রকার বিজয়–যাত্রা হিসেবে—এই চুক্তিকে টেকসই করতে সহায়তা করবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
#Trump #Hamas #Gaza #MiddleEastPeace #Diplomacy #Israel #Qatar #Iran #Ceasefire #USForeignPolicy