০৪:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
গোখরা সাপ: ভয় ও বিস্ময়ের এক জীবন্ত কিংবদন্তি আফ্রিকার স্বৈরশাসকরা: প্রাচীন যুগের অবশিষ্টাংশ নন, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি আদর্শ মার্কিন সার্জন জেনারেল পদে কেসি মিনস: কেনেডির ‘মেক আমেরিকা হেলদি অ্যাগেইন’ উদ্যোগে নতুন গতি ইঁদুরে ভরা শহর থেকে মুক্তির লড়াই — নিউইয়র্কের ডেটা-ভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা কেমন কাজ করছে ক্যাটসআই × 5 গাম: ‘ফাইনাল ড্রপ’-এ পপ কালচারের কামব্যাক কামড় আজ পার্থ থেকে ডব্লিউডব্লিউই ক্রাউন জুয়েল—দেখবেন কীভাবে গঙ্গামতি নির্ধারিত বন: কুয়াকাটার সবুজ ঢেউ ও হারিয়ে যাওয়া প্রাণের আর্তনাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৩৪) দিল্লিতে এ মৌসুমের প্রথম শীতল রাত নেমেছে- ১৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ‘জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত’: প্রচলিত ভোটব্যবস্থা শক্তিশালী করার আহ্বানে বিএনপি নেতারা

‘ওড়না কোথায়’ বলে তরুণীকে হেনস্তা, শাহবাগের যুবক মুক্তির পর ফুলের মালা — ইউনুস প্রতিনিধিদলের আখতার জাতিসংঘে নারীর সঙ্গে করমর্দন এড়িয়ে বিতর্ক

বাংলাদেশে নারী হেনস্তা, ধর্মীয় উগ্রতা ও মৌলবাদী মনোভাবের পুনরুত্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ‘ওড়না কোথায়’ বলে তরুণীকে অপমান, শাহবাগে হেনস্তাকারীর মুক্তির পর ফুলের মালা পরিয়ে সম্মাননা, আর জাতিসংঘে একজন প্রতিনিধির নারীর সঙ্গে করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া — এই তিনটি ঘটনার মিলিত চিত্র এক ভয়াবহ সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন, যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ ক্রমশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

মৌলবাদী মানসিকতার উত্থান

বাংলাদেশের জনপরিসরে সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদী ও নারীবিদ্বেষী মানসিকতা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ‘ওড়না কোথায়’ বলে রাস্তায় তরুণীকে হেনস্তা করা, শাহবাগে নারীকে অপমানজনক মন্তব্য করা, এবং জাতিসংঘের মঞ্চে একজন প্রতিনিধির নারীর সঙ্গে করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া—এই ঘটনাগুলো একই ধারার প্রতিফলন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও, নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রকাশ্য সমর্থন—সবকিছুই প্রমাণ করছে, সমাজের অন্তরালে তালেবানি চিন্তার বীজ আবারও গজিয়ে উঠছে।

ওড়না কোথায়’—একটি ভিডিওএকটি সময়ের প্রতিচ্ছবি

সম্প্রতি এক তরুণীকে ‘ওড়না কোথায়’ বলে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। মাত্র ৩৮ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছে—“ওড়না কোথায়?”, “তুমি মুসলমান না নাকি?”
কেউ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করছে, কেউ ধর্মের দোহাই দিচ্ছে। আশপাশের মানুষ ভিডিও ধারণ করছে, কিন্তু প্রতিবাদ করছে না।
এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নারীবাদী সংগঠন, মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ নাগরিকরা বলেন—এটি কেবল একজন নারীর ওপর নয়, বরং নারীর স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।

শাহবাগের পুরনো ঘটনা: গ্রেপ্তার থেকে ফুলের মালা

কয়েক মাস আগে শাহবাগে একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে। তখনও এক তরুণ প্রকাশ্যে এক নারীর পোশাক নিয়ে ‘ওড়না’ প্রসঙ্গ তুলে অপমানজনক মন্তব্য করে।
পুলিশ দ্রুত অভিযুক্তকে আটক করে, সমাজে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু কয়েকদিন পর সেই তরুণ জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরে এলে তথাকথিত “তওহিদি জনতা” নামের একটি গোষ্ঠী তাকে ফুলের মালা পরিয়ে “ধর্মরক্ষাকারী” হিসেবে বরণ করে নেয়।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যায়, তার গলায় ফুলের মালা, চারপাশে হাততালি ও স্লোগান—“ইনকিলাব জিন্দাবাদ”
মানবাধিকার কর্মী নাসিমা সুলতানা বলেন, “এই ঘটনায় বোঝা যায়, সমাজের একটি অংশ নারীবিদ্বেষকে ধর্মীয় নৈতিকতা হিসেবে গ্রহণ করছে—যা ভয়াবহ।”

জাতিসংঘে করমর্দন না করা: আন্তর্জাতিক পরিসরে সংকীর্ণতার প্রতিফলন

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের এক সদস্য আখতার, সভায় একজন মধ্যবয়সী নারী সহ-অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে করমর্দন করতে অস্বীকৃতি জানান।
ঘটনাটি উপস্থিত কূটনীতিকদের বিস্মিত করে। অনেকেই বলেন, এটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় হলেও আন্তর্জাতিক কূটনীতির শিষ্টাচারের পরিপন্থী এবং নারীর প্রতি অসম্মানজনক।
ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা হয়। অনেকে বলেন, দেশের ভেতরে যে মৌলবাদী মানসিকতা বাড়ছে, সেটি এখন আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রকাশ পাচ্ছে।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও বিভাজন

এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রবল বিতর্ক চলছে।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত লেখেন—“‘ওড়না কোথায়’ বলে যে ছেলেটা নারীকে হ্যারাস করল, তাকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে, নইলে উগ্র চিন্তার মানুষ আরও সাহসী হয়ে উঠবে।”
অ্যাক্টিভিস্ট সাদিক মাহবুব ইসলাম মন্তব্য করেন—“এগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, এটি পরিকল্পিত মতাদর্শিক আগ্রাসন। কেউ কনসার্ট বন্ধ করে, কেউ ওড়না নিয়ে হেনস্তা করে, কেউ জাতিসংঘে করমর্দন এড়িয়ে যায়—সব একই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।”
অন্যদিকে, কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠী এই কর্মকাণ্ডকে “ধর্মীয় দায়িত্ব” বলে ব্যাখ্যা করছে—“নারীরা যেন ইসলামি শালীনতা বজায় রাখে।”

তালেবানি চিন্তার পুনরুত্থান

সামাজিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই প্রবণতা মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলাদেশে অতীতে মৌলবাদী রাজনীতি দুর্বল হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সাংস্কৃতিক পুনরুত্থান ঘটছে।
বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ধর্মীয় প্রভাবশালীরা “ধর্ম রক্ষার” নামে নারীর পোশাক, শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণের ওপর বিধিনিষেধ প্রচার করছে।


রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবুল হোসেন বলেন, “যখন রাষ্ট্র দুর্বল হয়, উগ্রবাদীরা তখন সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জায়গা দখল করে নেয়—বাংলাদেশ এখন সেই ঝুঁকির মুখে।”

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যর্থতা

নারী হেনস্তা বা ধর্মীয় উগ্রতার ঘটনার পরও অপরাধীরা যদি সামাজিকভাবে ‘নায়ক’ হয়ে ওঠে, সেটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিফলন।
শাহবাগের ঘটনায় পুলিশের তৎপরতা প্রশংসনীয় হলেও, জামিনের পর সমাজের একাংশের তাকে ‘ধর্মরক্ষক’ বানিয়ে বরণ করা—আইনের দুর্বলতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
সমাজবিজ্ঞানী রওশন আরা বলেন, “যে সমাজে নারীবিদ্বেষকে পুণ্যকাজ হিসেবে দেখা হয়, সেখানে শুধু আইনি শাস্তি নয়, প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থা ও মানসিকতার পরিবর্তন।”

আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও ক্ষয়

জাতিসংঘের ঘটনাটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে।
একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বলেন, “বাংলাদেশ সবসময় সহনশীলতা ও নারী ক্ষমতায়নের বার্তা দিয়েছে। কিন্তু করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া বা নারীর প্রতি অসম্মান—বিশ্বমঞ্চে ভিন্ন বার্তা দেয়।”

তরুণ সমাজের বিভক্ত মনোভাব

তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও মতাদর্শিক বিভাজন স্পষ্ট হচ্ছে। কেউ ধর্মীয় শালীনতার নামে এমন আচরণকে যৌক্তিক বলছে, কেউ মানবাধিকারের ওপর আঘাত হিসেবে দেখছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রাশেদা খানম বলেন, “যে প্রজন্মকে আমরা মুক্তচিন্তা শেখাতে চেয়েছিলাম, তারা এখন সামাজিক মাধ্যমে উগ্র মতবাদ অনুসরণ করছে—এটি ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ।”

মানবিকতার বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনা

‘ওড়না কোথায়’, শাহবাগের মালা পরানো কিংবা জাতিসংঘে করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া—এই তিনটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা।
এগুলো প্রমাণ করে, নারীর প্রতি অসম্মান ও ধর্মীয় উগ্রতা মিলে এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে।
যে বাংলাদেশ একসময় নারীর মুক্তি, সহনশীলতা ও মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, সেই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে মানবিকতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধের পুনর্জাগরণ অপরিহার্য।
উগ্রতার বদলে প্রয়োজন ন্যায়, সহনশীলতা ও মানবতার আলোয় সমাজকে ফিরিয়ে আনা।

#ট্যাগসমূহ

#ওড়না_কোথায় #শাহবাগ_ঘটনা #তওহিদি_জনতা #ইউনুস_প্রতিনিধিদল #আখতার_বিতর্ক #নারীবিদ্বেষ #ধর্মীয়_উগ্রতা #মৌলবাদ #বাংলাদেশ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

গোখরা সাপ: ভয় ও বিস্ময়ের এক জীবন্ত কিংবদন্তি

‘ওড়না কোথায়’ বলে তরুণীকে হেনস্তা, শাহবাগের যুবক মুক্তির পর ফুলের মালা — ইউনুস প্রতিনিধিদলের আখতার জাতিসংঘে নারীর সঙ্গে করমর্দন এড়িয়ে বিতর্ক

১১:৫৫:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশে নারী হেনস্তা, ধর্মীয় উগ্রতা ও মৌলবাদী মনোভাবের পুনরুত্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ‘ওড়না কোথায়’ বলে তরুণীকে অপমান, শাহবাগে হেনস্তাকারীর মুক্তির পর ফুলের মালা পরিয়ে সম্মাননা, আর জাতিসংঘে একজন প্রতিনিধির নারীর সঙ্গে করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া — এই তিনটি ঘটনার মিলিত চিত্র এক ভয়াবহ সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন, যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ ক্রমশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

মৌলবাদী মানসিকতার উত্থান

বাংলাদেশের জনপরিসরে সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদী ও নারীবিদ্বেষী মানসিকতা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ‘ওড়না কোথায়’ বলে রাস্তায় তরুণীকে হেনস্তা করা, শাহবাগে নারীকে অপমানজনক মন্তব্য করা, এবং জাতিসংঘের মঞ্চে একজন প্রতিনিধির নারীর সঙ্গে করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া—এই ঘটনাগুলো একই ধারার প্রতিফলন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও, নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রকাশ্য সমর্থন—সবকিছুই প্রমাণ করছে, সমাজের অন্তরালে তালেবানি চিন্তার বীজ আবারও গজিয়ে উঠছে।

ওড়না কোথায়’—একটি ভিডিওএকটি সময়ের প্রতিচ্ছবি

সম্প্রতি এক তরুণীকে ‘ওড়না কোথায়’ বলে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। মাত্র ৩৮ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছে—“ওড়না কোথায়?”, “তুমি মুসলমান না নাকি?”
কেউ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করছে, কেউ ধর্মের দোহাই দিচ্ছে। আশপাশের মানুষ ভিডিও ধারণ করছে, কিন্তু প্রতিবাদ করছে না।
এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নারীবাদী সংগঠন, মানবাধিকারকর্মী ও সাধারণ নাগরিকরা বলেন—এটি কেবল একজন নারীর ওপর নয়, বরং নারীর স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।

শাহবাগের পুরনো ঘটনা: গ্রেপ্তার থেকে ফুলের মালা

কয়েক মাস আগে শাহবাগে একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে। তখনও এক তরুণ প্রকাশ্যে এক নারীর পোশাক নিয়ে ‘ওড়না’ প্রসঙ্গ তুলে অপমানজনক মন্তব্য করে।
পুলিশ দ্রুত অভিযুক্তকে আটক করে, সমাজে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু কয়েকদিন পর সেই তরুণ জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরে এলে তথাকথিত “তওহিদি জনতা” নামের একটি গোষ্ঠী তাকে ফুলের মালা পরিয়ে “ধর্মরক্ষাকারী” হিসেবে বরণ করে নেয়।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যায়, তার গলায় ফুলের মালা, চারপাশে হাততালি ও স্লোগান—“ইনকিলাব জিন্দাবাদ”
মানবাধিকার কর্মী নাসিমা সুলতানা বলেন, “এই ঘটনায় বোঝা যায়, সমাজের একটি অংশ নারীবিদ্বেষকে ধর্মীয় নৈতিকতা হিসেবে গ্রহণ করছে—যা ভয়াবহ।”

জাতিসংঘে করমর্দন না করা: আন্তর্জাতিক পরিসরে সংকীর্ণতার প্রতিফলন

ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের এক সদস্য আখতার, সভায় একজন মধ্যবয়সী নারী সহ-অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে করমর্দন করতে অস্বীকৃতি জানান।
ঘটনাটি উপস্থিত কূটনীতিকদের বিস্মিত করে। অনেকেই বলেন, এটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় হলেও আন্তর্জাতিক কূটনীতির শিষ্টাচারের পরিপন্থী এবং নারীর প্রতি অসম্মানজনক।
ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা হয়। অনেকে বলেন, দেশের ভেতরে যে মৌলবাদী মানসিকতা বাড়ছে, সেটি এখন আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রকাশ পাচ্ছে।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও বিভাজন

এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রবল বিতর্ক চলছে।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত লেখেন—“‘ওড়না কোথায়’ বলে যে ছেলেটা নারীকে হ্যারাস করল, তাকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে, নইলে উগ্র চিন্তার মানুষ আরও সাহসী হয়ে উঠবে।”
অ্যাক্টিভিস্ট সাদিক মাহবুব ইসলাম মন্তব্য করেন—“এগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, এটি পরিকল্পিত মতাদর্শিক আগ্রাসন। কেউ কনসার্ট বন্ধ করে, কেউ ওড়না নিয়ে হেনস্তা করে, কেউ জাতিসংঘে করমর্দন এড়িয়ে যায়—সব একই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।”
অন্যদিকে, কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠী এই কর্মকাণ্ডকে “ধর্মীয় দায়িত্ব” বলে ব্যাখ্যা করছে—“নারীরা যেন ইসলামি শালীনতা বজায় রাখে।”

তালেবানি চিন্তার পুনরুত্থান

সামাজিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই প্রবণতা মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলাদেশে অতীতে মৌলবাদী রাজনীতি দুর্বল হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সাংস্কৃতিক পুনরুত্থান ঘটছে।
বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ধর্মীয় প্রভাবশালীরা “ধর্ম রক্ষার” নামে নারীর পোশাক, শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণের ওপর বিধিনিষেধ প্রচার করছে।


রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবুল হোসেন বলেন, “যখন রাষ্ট্র দুর্বল হয়, উগ্রবাদীরা তখন সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জায়গা দখল করে নেয়—বাংলাদেশ এখন সেই ঝুঁকির মুখে।”

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যর্থতা

নারী হেনস্তা বা ধর্মীয় উগ্রতার ঘটনার পরও অপরাধীরা যদি সামাজিকভাবে ‘নায়ক’ হয়ে ওঠে, সেটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিফলন।
শাহবাগের ঘটনায় পুলিশের তৎপরতা প্রশংসনীয় হলেও, জামিনের পর সমাজের একাংশের তাকে ‘ধর্মরক্ষক’ বানিয়ে বরণ করা—আইনের দুর্বলতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
সমাজবিজ্ঞানী রওশন আরা বলেন, “যে সমাজে নারীবিদ্বেষকে পুণ্যকাজ হিসেবে দেখা হয়, সেখানে শুধু আইনি শাস্তি নয়, প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থা ও মানসিকতার পরিবর্তন।”

আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও ক্ষয়

জাতিসংঘের ঘটনাটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে।
একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বলেন, “বাংলাদেশ সবসময় সহনশীলতা ও নারী ক্ষমতায়নের বার্তা দিয়েছে। কিন্তু করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া বা নারীর প্রতি অসম্মান—বিশ্বমঞ্চে ভিন্ন বার্তা দেয়।”

তরুণ সমাজের বিভক্ত মনোভাব

তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও মতাদর্শিক বিভাজন স্পষ্ট হচ্ছে। কেউ ধর্মীয় শালীনতার নামে এমন আচরণকে যৌক্তিক বলছে, কেউ মানবাধিকারের ওপর আঘাত হিসেবে দেখছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রাশেদা খানম বলেন, “যে প্রজন্মকে আমরা মুক্তচিন্তা শেখাতে চেয়েছিলাম, তারা এখন সামাজিক মাধ্যমে উগ্র মতবাদ অনুসরণ করছে—এটি ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ।”

মানবিকতার বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনা

‘ওড়না কোথায়’, শাহবাগের মালা পরানো কিংবা জাতিসংঘে করমর্দন এড়িয়ে যাওয়া—এই তিনটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা।
এগুলো প্রমাণ করে, নারীর প্রতি অসম্মান ও ধর্মীয় উগ্রতা মিলে এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে।
যে বাংলাদেশ একসময় নারীর মুক্তি, সহনশীলতা ও মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, সেই বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে মানবিকতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধের পুনর্জাগরণ অপরিহার্য।
উগ্রতার বদলে প্রয়োজন ন্যায়, সহনশীলতা ও মানবতার আলোয় সমাজকে ফিরিয়ে আনা।

#ট্যাগসমূহ

#ওড়না_কোথায় #শাহবাগ_ঘটনা #তওহিদি_জনতা #ইউনুস_প্রতিনিধিদল #আখতার_বিতর্ক #নারীবিদ্বেষ #ধর্মীয়_উগ্রতা #মৌলবাদ #বাংলাদেশ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট