গোখরা সাপ, যাকে অনেকে কোবরা বা নাগ সাপ নামেও চেনে, পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় ও ভয়ংকর সরীসৃপ। দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল অঞ্চলে এই সাপের উপস্থিতি খুবই সাধারণ। এর মাথার পেছনে ফণা তোলা ভঙ্গি, চোখের মতো চিহ্ন এবং মারাত্মক বিষ—সব মিলিয়ে এই প্রাণীটি মানুষের কৌতূহল ও আতঙ্কের এক অনন্য মিশ্রণ। গোখরার নাম শুনলেই গ্রামীণ মানুষ ভয়ে সিঁটিয়ে ওঠে, কিন্তু একই সঙ্গে ধর্মীয়, লোককথা ও সংস্কৃতির গভীরে এই সাপকে পবিত্র বলেও মানা হয়। ভয় ও শ্রদ্ধার এই দ্বৈত সম্পর্কই গোখরাকে ঘিরে সৃষ্টি করেছে এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
গোখরার পরিচয় ও শ্রেণিবিন্যাস
গোখরা সাপ মূলত এলাপিডি (Elapidae) পরিবারভুক্ত এক প্রজাতি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Naja (সাধারণ কোবরা) এবং রাজগোখরার নাম Ophiophagus hannah, যাকে বাংলায় শঙ্খচূড় বলা হয়। গোখরারা সাধারণত বিষধর সাপ, এবং তাদের মাথার পেছনের হাড়ের কাঠামো এমনভাবে প্রসারিত হয় যে বিপদের সময় তারা ফণা তোলে। ‘কোবরা’ শব্দটির উৎপত্তি পর্তুগিজ ভাষা থেকে—‘Cobra de capelo’, যার অর্থ ‘হুডযুক্ত সাপ’। গোখরা বিভিন্ন উপপ্রজাতিতে বিভক্ত, যেমন ভারতীয় কোবরা, মনোকল কোবরা, স্পেক্ট্যাকল কোবরা এবং রাজগোখরা। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে সাধারণত ভারতীয় বা মনোকল কোবরা দেখা যায়, আর পাহাড়ি অঞ্চলে মাঝে মাঝে রাজগোখরার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়।
আকৃতি ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য
গোখরার সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো তার মাথার পেছনের প্রশস্ত ফণা। যখন সাপটি বিপদ অনুভব করে, তখন এটি গলার পেশী প্রসারিত করে একটি চওড়া হুড তৈরি করে, যা তাকে আরও ভয়ংকর দেখায়। সাধারণ গোখরার দৈর্ঘ্য দেড় থেকে দুই মিটার পর্যন্ত হয়, তবে রাজগোখরা পাঁচ মিটার বা তারও বেশি হতে পারে। রাজগোখরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিষধর সাপ হিসেবে পরিচিত। গোখরার রঙ সাধারণত বাদামি, ধূসর, কালো কিংবা তামাটে হয়। তার গায়ের ওপরের অংশে চিহ্নের ভিন্নতা দেখা যায়—কখনো চশমার মতো দুটি দাগ, কখনো রেখা বা বৃত্তাকার ছোপ। এদের চোখ বড়, দৃষ্টিশক্তি ভালো এবং জিহ্বা দিয়ে তারা পরিবেশের গন্ধ ও কম্পন বুঝতে পারে।
আবাসস্থল ও বিস্তৃতি
গোখরা সাপ সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু পছন্দ করে। তারা বন, ঝোপঝাড়, কৃষিজমি, নদীতীর, গর্ত কিংবা মানুষের বাড়ির আশপাশেও বাস করতে পারে। রাজগোখরা সাধারণত ঘন জঙ্গলে পাওয়া যায়, বিশেষত যেখানে প্রচুর শিকার পাওয়া যায়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা, সিলেটের চা-বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চল গোখরার প্রাকৃতিক আবাস হিসেবে পরিচিত। বন ধ্বংস, কৃষি জমি সম্প্রসারণ ও মানুষের বসতি বৃদ্ধির কারণে এখন গোখরার আবাস দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। ফলে তাদের মানুষের সংস্পর্শে আসার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে, যা অনেক সময় দুর্ঘটনা ডেকে আনে।
খাদ্যাভ্যাস ও শিকারের কৌশল
গোখরা মূলত মাংসাশী প্রাণী। তারা ইঁদুর, ব্যাঙ, টিকটিকি, পাখির ছানা, এমনকি অন্যান্য সাপকেও খেয়ে থাকে। রাজগোখরার নামের মধ্যে ‘Ophiophagus’ শব্দের অর্থই হলো ‘সাপখাদক’। এরা সাধারণত দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে, এবং তাদের শিকার পদ্ধতি অত্যন্ত নিখুঁত। শিকার দেখতে পেলে তারা নিঃশব্দে এগিয়ে যায়, তারপর বিষাক্ত দাঁত দিয়ে একবার দংশন করেই শিকারকে নিস্তেজ করে ফেলে। বিষ শরীরে প্রবেশ করার পর অল্প সময়ের মধ্যেই শিকার পক্ষাঘাতে মারা যায়। শিকার ধরার সময় গোখরার দ্রুততা ও নিখুঁত আঘাত বিজ্ঞানীদের কাছেও বিস্ময়কর এক প্রক্রিয়া।
বিষের প্রকৃতি ও প্রভাব
গোখরার বিষ নিউরোটক্সিন জাতীয়, যা স্নায়ুতন্ত্রকে প্যারালাইস করে দেয়। কামড়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই শিকার বা মানুষ শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করে, কারণ বিষ স্নায়ুর মাধ্যমে শ্বাসপ্রশ্বাসের পেশীকে অবশ করে ফেলে। গোখরার বিষ সাধারণত প্রাণঘাতী হলেও, কামড়ের মারাত্মকতা নির্ভর করে বিষের পরিমাণ, কামড়ের স্থান এবং দ্রুত চিকিৎসার ওপর। রাজগোখরার বিষের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি, তবে এর বিষের মারাত্মকতা সাধারণ কোবরার চেয়ে কিছুটা কম। তবুও একটি পূর্ণ কামড় মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। গোখরার বিষ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হয়, যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সাপের কামড় প্রতিরোধে। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, এই বিষ থেকে কিছু স্নায়ুবিষয়ক রোগের ওষুধ তৈরির সম্ভাবনাও রয়েছে।
প্রজনন ও ডিম পাড়া
গোখরা সাপ ডিম পাড়া প্রাণী। সাধারণত গ্রীষ্মকালে স্ত্রী গোখরা নিরাপদ জায়গায় ২০ থেকে ৪০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। রাজগোখরা অন্যান্য সাপের তুলনায় একমাত্র প্রজাতি যারা ডিম পাড়ার পর সেই ডিম পাহারা দেয়। স্ত্রী সাপ ঘাস ও পাতায় একটি বাসা তৈরি করে এবং ডিম ফোটার আগ পর্যন্ত সেটি পাহারা দেয়। এই সময়ে মাতা সাপ অত্যন্ত আক্রমণাত্মক হয় এবং কাউকে কাছে আসতে দেয় না। প্রায় দুই মাস পর ডিম থেকে ছোট সাপ জন্ম নেয়, যাদের শুরু থেকেই বিষ থাকে। বাচ্চারা জন্মের পরপরই নিজের পথে চলে যায় এবং স্বাভাবিকভাবে শিকার করতে শুরু করে। এটি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া, যেখানে মাতৃত্ব ও স্বনির্ভরতা এক সঙ্গে কাজ করে।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
গোখরা সাপ মানুষের সংস্কৃতি, ধর্ম ও লোকজ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হিন্দু ধর্মে নাগ দেবতা বা নাগিনী পূজিত, যেখানে সাপকে শক্তি, রক্ষা ও পুনর্জন্মের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। শিবের গলায় কোবরা সাপকে দেখা যায়, যা ক্ষমতা ও ধৈর্যের প্রতীক। বাংলাদেশ ও ভারতের বহু অঞ্চলে নাগপঞ্চমী উৎসব পালিত হয়, যেখানে গোখরাকে দুধ দিয়ে পূজা করা হয়। অন্যদিকে গ্রামীণ জীবনে গোখরাকে ভয়ঙ্কর শত্রু হিসেবেও দেখা হয়, বিশেষ করে যখন তারা ঘরে বা ধানের গোলায় ঢুকে পড়ে। মানুষ ও গোখরার এই সম্পর্ক একদিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক, অন্যদিকে সংঘাতময়ও বটে। অনেকে গোখরাকে দেখলেই মেরে ফেলে, আবার কেউ কেউ তাদের বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে বিভিন্ন প্রাণিবিদ ও সংরক্ষণবাদীরা সাপ রক্ষার জন্য বিশেষ প্রচার চালাচ্ছে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে—সাপ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে সাপের ভূমিকা অপরিসীম, কারণ একটি গোখরা বছরে শত শত ইঁদুর খেয়ে ফসল রক্ষা করে।
লোকশিল্প ও সাপখেলা
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ‘সাপের খেলা’ একসময় জনপ্রিয় লোকশিল্প ছিল। সাপুড়ে বা ‘বীন বাজিয়ে’ বাঁশির তালে কোবরাকে নাচাতে দেখা যেত। মানুষ ভাবত সাপ বাঁশির সুর শুনে নাচে, কিন্তু বাস্তবে সাপ শব্দ শুনতে পায় না—তারা বাঁশির নড়াচড়া দেখে সাড়া দেয়। এই খেলা দেখতে যতটা আকর্ষণীয়, সাপের জন্য তা ততটাই কষ্টদায়ক। অনেক সময় সাপের দাঁত তুলে ফেলা হয় বা বিষনালি বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়। তাই এখন আইনত এই ধরনের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ। সাপুড়ে সমাজের জীবিকা যেমন হারিয়েছে, তেমনি সাপও বেঁচে গেছে এক নিষ্ঠুর পরিণতি থেকে।
গোখরা সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা
গোখরা সাপ সম্পর্কে বহু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, গোখরা সবসময় আক্রমণ করে, কিন্তু বাস্তবে সাপ কখনো অযথা আক্রমণ করে না—শুধু আত্মরক্ষার জন্যই ফণা তোলে বা কামড় দেয়। কেউ কেউ বিশ্বাস করে সাপ প্রতিশোধ নেয়, কিন্তু প্রাণিজগতে এমন মানসিকতা নেই। অনেকের ধারণা সাপ দুধ খায়, যা সম্পূর্ণ ভুল—সাপ দুধ হজমই করতে পারে না। আবার কেউ ভাবে সাপ বাঁশির সুর শুনে নাচে, সেটিও আসলে দৃষ্টিকেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। এসব ভুল ধারণা দূর করা জরুরি, যাতে মানুষ সাপকে ভয় না পেয়ে বুঝে চলতে শেখে।
মানুষের জন্য বিপদ ও প্রতিরোধ
বাংলাদেশে প্রতিবছর শতাধিক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, যার বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকা থেকে। রাতের বেলায় খালি পায়ে চলাফেরা, ধান রাখার গুদামঘরে হাত দেওয়া বা নদীতীরে কাজ করার সময় সাপ কামড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে। কামড়ানোর পর অনেকে স্থানীয় ওঝা বা কবিরাজের কাছে যায়, যার ফলে চিকিৎসা বিলম্বিত হয় এবং মৃত্যুহার বেড়ে যায়। সঠিক উপায় হলো দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন নেওয়া। এছাড়া, বাসার চারপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখা, রাতে টর্চ ব্যবহার করা এবং খালি পায়ে না হাঁটা—এসব সতর্কতা জীবন বাঁচাতে পারে।
পরিবেশে গোখরার ভূমিকা
গোখরা প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী খেয়ে কৃষির ক্ষতি রোধ করে। একদিকে তারা শিকারি, অন্যদিকে নিজেরাও বড় শিকারির খাদ্য হয়। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গোখরা অপরিহার্য। যদি সাপ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে ইঁদুরের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে কৃষি উৎপাদনে বড় ধস নামবে। তাই সাপ হত্যা মানে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করা।
সংরক্ষণ ও আইন
গোখরা সাপ এখন অনেক অঞ্চলে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত। বাংলাদেশে রাজগোখরা বা শঙ্খচূড় সংরক্ষিত প্রজাতি হিসেবে বন অধিদপ্তরের আওতায় সুরক্ষা পায়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ অনুযায়ী এই সাপ হত্যা বা ধরার শাস্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। তাছাড়া বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এবং প্রাণিবিজ্ঞানীরা সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছেন। তারা স্কুল ও স্থানীয় সমাজে প্রচার চালাচ্ছেন—“সাপ শত্রু নয়, প্রকৃতির বন্ধু।” এমন সচেতনতাই গোখরার মতো মূল্যবান প্রাণীকে টিকিয়ে রাখতে পারে।
গোখরা সাপ শুধু এক বিষধর প্রাণী নয়, এটি প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য প্রতীক। তার ফণা তোলা ভঙ্গি যেমন ভয় জাগায়, তেমনি প্রকৃতির সৌন্দর্য ও শক্তির প্রতীকও হয়ে ওঠে। গোখরাকে ভয় নয়, বরং সম্মান ও সহাবস্থানের চোখে দেখা উচিত। মানুষ যদি বুঝতে শেখে যে সাপও জীবনের অংশ, তাহলে একদিন হয়তো আমাদের মাঠ, বন ও নদীতীরে আবারও নিরাপদে ফণা তুলবে এই কিংবদন্তির সাপ—মানুষের পাশে, প্রকৃতির ভারসাম্যের প্রতীক হয়ে।